জীবদেহে বহুকোশীয়তার সুবিধা ও অসুবিধা লেখ

জীবদেহে বহুকোশীয়তার সুবিধা (Advantages of Multicellularity to the Organism): 

 

এককোশী জীবদের তুলনায় বহুকোশী জীবেরা অনেক বেশি সুযোগসুবিধা ভোগ করে। এগুলি নীচে আলোচিত হল-

 

  1. দ্বৈত ক্রিয়া (Dual function): বহুকোশী জীবদের কোশ দ্বৈত ভূমিকা পালন করে-একটি নিজেদের জন্য কোশের অস্তিত্ব রক্ষার্থে এবং অপরটি সমগ্র জীবদেহের জন্য। 

 

  1. বৃদ্ধির সীমাবদ্ধতার দূরীকরণ (Avoidance of limitation in growth): এককোশী জীব আকার-আয়তনে বৃদ্ধি পেতে পারে, কিন্তু সেইরূপ বৃদ্ধি সীমাবদ্ধ, কারণ আকার-আয়তনে অতিরিক্ত বৃদ্ধি টিকে থাকার ক্ষেত্রে ও অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে অসংগত (কারণ, সেক্ষেত্রে দেহতলের বৃদ্ধি ও আকারের বৃদ্ধির আনুপাতিক মান হ্রাস পায়)। অপরপক্ষে, বহুকোশী জীব কোশ বিভাজনের দ্বারা কোশের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে দেহের আকার আয়তনের সংগতি রেখে বৃদ্ধি ঘটাতে পারে। কোশের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে দেহের কোশতলের ক্ষেত্র বৃদ্ধি করে যা বিভিন্ন জীবজ ক্রিয়া সম্পাদনের সহায়ক।

 

  1. পরিবেশের বাধা বা চাপ দূরীকরণ (Avoidance of environmental stress): বহুকোশী জীবদেহের সব কোশ

 

প্রত্যক্ষভাবে বহিঃপরিবেশের সংস্পর্শে থাকে না। তাদের দেহের যেসব কোশগুলি বহিঃপরিবেশের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে থাকে, তারা বহিঃস্তর (epidermis) বা ত্বক (skin) গঠন করে-যা তাদের ভিতরের কোশগুলিকে বহিঃপরিবেশের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ থেকে ও পরিবেশের বাধা থেকে দূরে রাখে। এইভাবে জীবদেহের সর্বাপেক্ষা বহিঃস্তরীয় কোশস্তর রূপান্তরিত হয়ে বিভিন্ন অঙ্গের রক্ষাকবচরূপে কাজ করে।

 

  1. শ্রমবন্টন (Distribution of labour): একটি সামগ্রিক জীবরূপে একটি সজীব দেহকে পূর্বোস্ত নানাবিধ কাজ সম্পন্ন করতে হয়। যদিও অনুরূপ কাজ একটি এককোশী জীবকেও সম্পন্ন করতে হয়। তথাপি জীবের বহুকোশীয়তার ফলে কোশসমূহের মধ্যে শ্রমবন্টন সহজসাধ্য হয়েছে। জীবের জীবনযাত্রার উদ্দেশ্য পূরণের জন্য জীবদেহে নির্দিষ্ট কার্য সম্পাদনকারী স্বতন্ত্র (specilaized) কলা, যন্ত্র ও তন্ত্রের উদ্ভব ঘটেছে। বহুকোশী জীবদেহে কোশের এইরূপ শ্রমবন্টন ব্যবস্থা একক কোশের কাজের বোঝা লাঘব করে।

 

  1. অস্তিত্ব রক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি (Increasing in chance of survivality): জীবের বহুকোশীয়তার ফলে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সুযোগ বৃদ্ধি পায়। পরিবেশের বাধার প্রভাবে কিছু কোশের মৃত্যু ঘটতে পারে, কিন্তু দেহের অন্যান্য কোশসমূহ জীবের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে উৎসাহিত করে।

 

  1. ক্ষয় হ্রাস (Reduction of wear and tear): বহুকোশী জীবদেহে কোশের মধ্যে শ্রমবন্টনের ফলে বিশেষ কাজ সম্পাদনের জন্য বিভিন্ন কোশগুচ্ছের সৃষ্টি হওয়ায় তাদের কাজের চাপ লাঘব হয়েছে, ফলে তাদের ক্ষয়-ক্ষতির হারও ন্যূনতম হয়েছে। এইজন্য সামগ্রিকভাবে কোশের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু তাই নয়, জীবদেহের কোনো কোনো অঙ্গের জীর্ণ কোশগুলি নতুন কোশ দ্বারা প্রতিস্থাপনের সুযোগ পায়। এইপ্রকার সুযোগ কেবলমাত্র বহুকোশী জীবদেহেই পাওয়া সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, ত্বকের জীর্ণ ও মৃত কোশগুলি স্ট্যাটাম জারমিনেটিভাম (stratum germinativum) থেকে উৎপন্ন কোশ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। অনুরূপভাবে 120 দিন জীবনকালের পর RBC মারা গেলে অস্থিমজ্জা থেকে নতুন উৎপন্ন কোশ যারা প্রতিস্থাপিত হয়।

 

  1. বহুকোশীয়তা প্রজাতির দীর্ঘ স্থায়িত্ব দান করে (Multicellularity confers enough stability to a species): বহুকোশী জীবদেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলি দেহের গভীরে অবস্থান করায় পরিবেশের পরিবর্তনশীলতার প্রভাবকের প্রভাব উপেক্ষা করতে পারে। অধিকাংশ জীবদেহেই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গাগুলি, যেমন-জননগ্রন্থি (শুক্রাশয় বা ডিম্বাশয়), দেহের এমন স্থানে অবস্থিত যেখানে পরিবর্তনকারী প্রভাবকগুলির সান্নিধ্য এড়াতে পারে। অপরপক্ষে, বলা যায় এটি অপত্যে সঞ্চরণশীল প্রজননিক বস্তুকে সুরক্ষিত করে। জীবের এইরূপ কিছু সুরক্ষা কৌশল প্রমাণ করে যে প্রকৃতিতে এককোশী জীব অপেক্ষা বহুকোশী জীবের স্থায়িত্ব অনেক বেশি।

 

• জীবদেহে বহুকোশীয়তার অসুবিধা (Disadvantages of Multicellularity of the Organism): 

 

বহুকোশী জীব তার বহুকোশীয়তার জন্য কিছু অসুবিধারও সম্মুখীন হয়। এগুলি নিম্নরূপ-

 

  1. বিশেষীকরণ জীবনীশক্তি হ্রাস করে (Specialization leads to loss of potentiality): বহুকোশী জীবদেহে শ্রমবন্টন কোশের বিভেদকরণের (differentiation) সঙ্গেঙ্গ জড়িত। এই ঘটনার ফলে দেহকোশগুলি কোনো নির্দিষ্ট কাজের জন্য চূড়ান্তভাবে বিশেষিত (specialized) হওয়ার ফলে একপ্রকার কোশ অন্য কোশের মতো কাজ করতে পারে না। প্রসঙ্গত এককোশী জীবকোশের সব ধরনের কাজ সম্পাদন করার ক্ষমতা থাকে। সুতরাং বিশেষিত কোশগুলির নানাবিধ কাজ করার ক্ষমতা হ্রাস পায়। এইপ্রকার কোশ যখন বিপরীতভাবে বিভেদিত (differentiated) হয় (কারসিনোজেনেসিসের সময়) তখন কাজ করার ক্ষমতা অর্জন করে। একটি ভ্রুণাণু (zygote) যে শক্তি (potency) বা ক্ষমতাবলে একটি সম্পূর্ণ জীবদেহ গঠন করে সেই ক্ষমতাকে টোটিপোটেন্সি (Totipotency; লাতিন-totus all, potens powerful; অর্থাৎ সার্বিক শক্তিমান) বলে। কোশের বিভেদকরণের ফলে দেহকোশের এই ক্ষমতা (potentiality) নষ্ট হয়।

 

  1. বহুকোশী জীবদেহে কোশ ও দেহের মধ্যে সমন্বয় ব্যবস্থা (co-ordination) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোনো কারণে যদি এই সমন্বয় বিঘ্নিত হয় বা নষ্ট হয়, তাহলে জীবদেহের স্বাভাবিক কাজগুলির ছন্দবদ্ধতা নষ্ট হয় এবং জীবেরও মৃত্যু ঘটে। সুতরাং সমন্বয়বিহীন বহুকোশীয়তার কোনো অর্থই হয় না।

 

  1. বহুকোশীয়তার ফলে কোশের স্বতন্ত্রতা (individuality) নষ্ট হয়। যদিও দেহে প্রতিটি কোশ নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব (identity) বজায় রাখে, তবুও তারা পারস্পরিক নির্ভরশীলতার ভিত্তিতে টিকে থাকে। অন্যান্য কোশের সহযোগিতা ছাড়া কোনো একটি কোশ সাধারণত এককভাবে টিকে থাকতে পারে না বা নির্দিষ্ট কোনো কাজ করতে পারে না।

 

উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, প্রত্যেক কোশ তখনই টিকে থাকার ক্ষমতা প্রদর্শন করে যখন রক্ত সংবহনতন্ত্রের সময় RBC-গুলি তাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ O₂ সরবরাহ করে। স্নায়ুতন্ত্রের সংজ্ঞাবহ গ্রাহকগুলির কাজ তখনই অর্থবহ হয় যখন কেন্দ্রীয় শয়ুতন্ত্রের স্নায়ুকোশগুলি তাদের সঙ্গে যুক্ত থাকে।।

 

প্রভেদক ভেদ্য আবরণীবেষ্টিত প্রোটোপ্লাজম দিয়ে গঠিত স্ব-প্রজননশীল জীবদেহের গঠনমূলক ও জৈবনিক ক্রিয়ামূলক একককে কোশ বলে।

 

Post Comment

You May Have Missed