বিভিন্ন প্রকার ধাতব পদার্থ রক্তে শোষিত হওয়ায় দূষণ

জৈববিবর্ধনের ঘটনা কেবলমাত্র জৈব পদার্থেই সীমাবদ্ধ থাকে না। ভারী ধাতু খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে জৈববিবর্ধিত হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ক্যাডমিয়াম, পারদ ও সিসার মাধ্যমে জৈববিবর্ধন ঘটে। এই সমস্ত বিষান্ত ধাতুগুলি খাদ্য ও জলের মাধ্যমে দেহের ভিতরে প্রবেশ করে এবং বিভিন্ন ধরনের রোগ সৃষ্টি করে। পাঠ্যক্রম অনুযায়ী তিনটি ধাতু থেকে কীরূপ বিষক্রিয়া দেখা দেয় এখানে তা আলোচনা করা হল।

 

■ সিসা (Lead-Pb) ঃ 

 

আমাদের দেশে প্রায় 200 ধরনের শিল্পে সিসা ব্যবহৃত হয়। এদের মধ্যে জাহাজ নির্মাণ, ছাপাখানা, রাবার, মৃৎশিল্প, ব্যাটারি, কাচ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এদের থেকে বিষক্রিয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। শিশুদের খেলনার রং, ছবি আঁকার রং, ডট পেনের কালি, সিসা ঝালাই দেওয়া পাত্রের থেকে বিষক্রিয়া ঘটতে পারে। পানীয় জলে 0.05 mg/L এবং রক্তে 0.2-0.4 ppb (parts per billion) হল সিসার গ্রাহ্যমাত্রা।

 

উৎস: 

 

(1) গ্যাসোলিন এবং মোটর গাড়ির ধোঁয়া (টেট্রাইথাইল লেড) থেকে হাজর হাজার টন সিসা প্রতি বছর পরিবেশে মেশে। (১) সিসা দিয়ে তৈরি নলের মাধ্যমে জল সরবরাহ করলে বা সিসার জলাধার ব্যবহার করলেও সেই জল থেকে বিষক্রিয়া ঘটে থাকে। (ii) শিশুদের খেলনার রং, ছবি আঁকার রং, ডটপেনের কালি, সিসা ঝালাই দেওয়া পাত্রের থেকে বিষক্রিয়া ঘটতে পারে। (iv) মৃৎশিল্পে ব্যবহৃত সিসা, ঘরবাড়ির রঙে ব্যবহৃত সিসা প্রভৃতি থেকেও বিষক্রিয়া ঘটে।

 

উপসর্গ: 

 

সিসা দ্বারা দূষণের ফলে মানবদেহে ডিসলেক্সিয়া (Dislexia) রোগ হয়। এর ফলে মস্তিষ্কে বিষময় প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। মানসিক অবসাদগ্রস্ত ও স্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তির (IC)) ওপর প্রভাব বিস্তার করে। স্বাভাবিক ব্যবহার ও কর্মধারার আমূল পরিবর্তন ঘটে। এই ধাতু হিমোগ্লোবিন ও সুত্রাশয়ের গঠন ব্যাহত করে । এছাড়া ক্ষুধামান্দ্য, বমিভাব, বমি, দাঁতের মাড়িতে নীল দাগ, সাংঘাতিক কোষ্ঠকাঠিন্য, রক্তাল্পতা, মাংসপেশি শ্লথ, হাত ও পা নীচের দিকে ঝুঁকে পড়ে, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে, মানসিক বিভ্রান্তি, ভুলবকা প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দেয়। মস্তিষ্কে নিউরোনের ক্ষতিসাধন এবং চেষ্টীয় স্নায়ুর অবক্ষয় ঘটে। রেনাল ফাইব্রোসিস ও গ্লোমেরুলার স্কেরোসিস ঘটে। স্ত্রীলোকের গর্ভপাত ঘটে অথবা মৃত সন্তানের প্রসব ঘটে। 

 

প্রতিরোধ: 

 

(1) যথাসম্ভব সিসার ব্যবহার কমানো, সিসার পরিবর্তে অন্য ধাতু ব্যবহার করা যা ক্ষতি করে না। (ii) লোকালয় থেকে দূরে শিল্প-কারখানা তৈরি করা যাতে সিসার ধোঁয়া বা ধুলো মানুষের মধ্যে প্রবেশ না করে। (iii) যেসব কারখানায় সিসা নিয়ে কাজ হয়, সেই সমস্ত স্থানের বায়ুতে যেন সিসার মাত্রা বিপদসীমার নীচে থাকে সেদিকে লক্ষ রাখা। (iv) ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যরক্ষা অর্থাৎ কারখানায় স্নান করার, হাত-পা ধোয়ার ব্যবস্থা রাখা। (v) স্বাস্থ্যশিক্ষার মাধ্যমে কর্মীদের সচেতন করার ব্যবস্থা করা। (vi) ছোটোদের লেখার বা ছবি আঁকার সময় কালি বা রং যাতে কোনো প্রকারে মুখে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

 

ক্যাডমিয়াম (Cadmium-(d) : 

 

শক্তি উৎপাদন কেন্দ্রে কয়লা পোড়ানো ছাই হল ক্যাডমিয়ামের মতো একটি বিষাক্ত ধাতুর উৎস। কয়লাতে ক্যাডমিয়াম থাকে খুব কম পরিমাণে কিন্তু ছাইতে এর মাত্রা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। এই ছাই যখন জমি ভরাট করতে ব্যবহার করা হয়, তখন ভারী ধাতুগুলি বিভিন্ন পরিমাণে ধুয়ে বেরিয়ে এসে মাটিতে মিশে যায়। ওই মাটিতে যেসব গাছপালা জন্মায় তাতে ক্যাডমিয়ামের মাত্রা ধাতু ছাইয়ের উপস্থিত মাত্রার তুলনায় প্রায় পাঁচগুণ ঘনীভূত হয়। গাছপালা থেকে এই ক্যাডমিয়াম তৃণভোজী প্রাণীদের মধ্যে সঞ্চারিত হয় এবং পরবর্তীকালে মানুষ সহ অন্যান্য প্রাণীতে ছড়িয়ে পড়ে। ক্যাডমিয়ামের মাত্রা এইভাবে পঞ্চাশ থেকে যাট গুণ বৃদ্ধি পেলে মানবদেহে ইটাই ইটাই (itai itai) রোগ সৃষ্টি করে। পানীয় জলে 0.01 mg ক্যাডমিয়ামের গ্রাহ্যমাত্রা।

 

উৎস: 

 

(i) খনিজ আকরিক থেকে সিসা, দস্তা গলানোর সময় ক্যাডমিয়াম পরিবেশে মেশে। (ii) শিল্পের বিভিন্ন বর্জ্যপদার্থ থেকে ক্যাডমিয়াম বাতাসে মেশে। (iii) প্লাস্টিক দ্রব্য পোড়ালে, ধাতব দ্রব্য পরিষুত করলে এবং তামাকের ধোঁয়া থেকে ক্যাডমিয়াম পরিবেশে আসে।

 

• উপসর্গ: 

 

দীর্ঘদিন ধরে ক্যাডমিয়াম দেহে ঢুকলে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে। এটি ফুসফুস ও বৃক্কের ক্ষতি করে। লেমোনেড ক্যাডমিয়াম ধাতুর তৈরি পাত্রে রাখলে, তার বিষক্রিয়া থেকে বমিভাব, বমি, পাতলা পায়খানা এবং দৈহিক দুর্বলতা দেখা দেয়। নানারকম বিপাকীয় অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়, উচ্চ রক্তচাপের সৃষ্টি হয়। অস্থিসন্ধিতে তীব্র যন্ত্রণা হয়। অস্থি ক্রমশ ছিদ্রযুক্ত, বায়ুপূর্ণ ও ভঙ্গুর হয়।

 

• প্রতিরোধ:

 

 (i) আকরিক গলানোর সময় সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। (ii) যেসব দ্রব্যে প্লাস্টিক, তেজস্ক্রিয় রং আছে এবং যেসব ওষুধে ক্যাডমিয়াম আছে তা ব্যবহার না করা। (iii) ক্যাডমিয়াম ধাতু নির্মিত পাত্রে অম্ল খাদ্য না খাওয়া। 

 

■ পারদ (Mercury-Hg) : 

 

পারদ দ্বারা বিষক্রিয়া বা দূষণ প্রসঙ্গ এলেই সর্বপ্রথম যে বিষয়টি আমাদের নাড়া দেয় তা হল মিনামাটা (Minamata) রোগ। 1953 থেকে 1960 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে জাপানের মিনামাটা সমুদ্রের জল একটি রাসায়নিক কোম্পানি থেকে ফেলে দেওয়া বর্জ্য পারদের বিষে বিষাক্ত হয়ে ওঠে। এর ফুলে সামুদ্রিক খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে ওই সমুদ্রের মাছের মধ্যেও পারদ সংক্রামিত হয়। ফলে ওই বিষাক্ত মাছ খেয়ে বহুলোকের মধ্যে পেশি ও স্নায়ুর রোগ হয়। এছাড়া, দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলা, বধিরত্ব, স্মৃতিবিভ্রম প্রভৃতি রোগে লোকজন আক্রান্ত হয়। কয়েক হাজার শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ সারাজীবনের মতো পঙ্গু হয়ে যায়। বহু মানুষের প্রাণহানিও ঘটে। পানীয় জলে 0.002 mg এবং রক্তে 0.5 ppm (parts per million) পারদের গ্রাহ্যমাত্রা।

 

উৎস: 

 

(i) ভূত্বকের স্বাভাবিক গ্যাস থেকে কিছু পরিমাণ পারদ পরিবেশে যুক্ত হয়। (i) কয়লা পোড়ানো, স্টিল ও সিমেন্ট তৈরির সময় এবং ধাতু আকরিক গলাবার সময়ও পরিবেশ দূষণ ঘটে। (iii) ইরাকে গমবীজের ছত্রাক মারার কাজে ব্যবহৃত পারদজাত পদার্থও উৎস হিসেবে কাজ করে। (iv) জাপানের মিনামাটায় স্থানীয় কারখানা থেকে পারদজাত পদার্থ ‘মিথাইল মার্কারি’ প্রথম নদী ও সাগরের জলে পড়ে মাছের মাধ্যমে মানবদেহে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে।

 

• উপসর্গ: 

 

দীর্ঘস্থায়ী বিষক্রিয়ার ফলে লালা পড়ে, মুখের ভিতর ঘা হয়, পাতলা পায়খানায় হয়। হাত, পা, জিভ, ঠোঁট কাঁপে, হাঁটাচলার অসুবিধা হয়। ঘুম ব্যাহত হয়। পারদ গ্যাস ফুসফুসে গেলে ফুসফুসের শোথ হয়। সর্বোপরি ‘মিনামাটা’ (Minamata) রোগ দেখা দেয়। এই রোগে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র আক্রান্ত হয়, দৃষ্টিবিভ্রম, বধিরতা, স্মৃতিবিভ্রম, অসাড়তা প্রভৃতি দেখা যায়।

 

প্রতিরোধ: 

 

(i) পারদজাত বর্জ্যপদার্থ নদী, জলাশয় বা সমুদ্রের জলে সরাসরি ফেলা বন্ধ করতে হবে। (ii) গমবীজের ছত্রাক মারার জন্য পারদজাত পদার্থ ব্যবহৃত হলে, সেই গম থেকে আটা, ময়দা তৈরি করা যবে না।

Post Comment

You May Have Missed