আদি বা প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা কিভাবে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে তা আলোচনা করো 2024

আদি বা প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা কিভাবে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে তা আলোচনা করো 2024

উত্তর:- ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাসের গৌরবকে অনেক ক্ষেত্রে ধ্রুপদী সংস্কৃতি রূপে উল্লেখ করা হয়। আবার অনেকে এই প্রাচীন প্রাগৈতিহাসিক সমাজ সভ্যতার বিবর্তন ধারাকে ধীশক্তি সম্পন্ন বলে উল্লেখ করেছেন।

‘জন লুবেক প্রথম প্রাগৈতিহাসিক ইতিহাসের ব্যাখ্যা দেন। এই প্রেক্ষিতে প্রাগৈতিহাসিক ভারতের ইতিহাসের সূচনা হয় আনুমানিক প্রায় আড়াই লক্ষ বছর পূর্বে। এই যুগের কোনো লিখিত উপাদান পাওয়া যায় না। দৈনন্দিন জীবনে শিক্ষার ও খাদ্য সংগ্রহের জন্য মানুষ নিজেদের মধ্যে আকারে ইঙ্গিতে কথা বলত। কিন্তু সে ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষার কোনো লিখিত রূপ ছিল না। তাই প্রাগৈতিহাসিক ভারতের জীবন সংস্কৃতি রসায়ন জানার অন্যতম উপাদান হল প্রত্নতাত্তিক উপাদান, বিশেষত গাছের ডাল ও প্রস্তর নির্মিত হাতিয়ার, মৃৎশিল্প, বাসস্থান, গৃহস্থালির সরঞ্জাম প্রভৃতি। এছাড়া জীবাশ্ম, গুহাচিত্র, সমাধিস্থান, ধ্বংসাবশেষ প্রভৃতিকে প্রাগৈতিহাসিক ভারতীয়দের আদি বা প্রারম্ভিক ইতিহাসের উপাদান বলা হয়।

ভারতের মাটিতে মানবাকার আধুনিক প্রজাতির উদ্ভব হয় আজ থেকে প্রায় পাঁচ লক্ষ বছর আগে। প্রাগৈতিহাসিক এই মানুষদের বলা হয় ‘গুহা মানব’। এরা প্রথমে পাহাড়ের গুহাতে বসবাস করত। গুহাগুলি পর্যাপ্ত না থাকায় ডালপালা, লতাপাতা, হাড়, বাঁশ, মাটি প্রভৃতি দিয়ে ঝুপড়ি ঘর তৈরি করত। কখনো চামড়ার ছাউনি দিয়ে তারা ঘর বাঁধত।

শিকারী গুহা মানবরা ছিল খাদ্য সংগ্রাহক। পাথর ও পশুর হাড় দিয়ে তৈরি হাতকুঠার, ছুরি, বর্শা, তীর-ধনুক প্রভৃতি হাতিয়ার দিয়ে তারা শিকার সংগ্রহ করত। বন্যপশুর মাংস, ফলমূল ছাড়াও নদীর মাছ, পাখির ডিম, শাকসবজি তারা দলবদ্ধভাবে শিকার ও সংগ্রহ করত। একই গুহায় বসবাসকারী বা প্রতিবেশী সঙ্গে রক্তের সম্পর্কযুক্ত শিকারীদের নিয়ে দল গঠন করত। এই দলগুলিকে ‘ক্ল্যান’ বলা হত। আবার বড়ো কোনো জন্তু শিকারের জন্য সহযোগী কয়েকটি গোষ্ঠী জোটবদ্ধ হত, তাকে ‘কৌম’ বলা হত। একটি নির্দিষ্ট দল বা গোষ্ঠী একটি নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে শিকার করত। প্রথমে

নারী-পুরুষ সকলে একসাথে শিকার করলেও পরবর্তীতে নারীদের জন্য ঘর, দৈনন্দিন জীবন এবং গৃহপালিত পশু প্রতিপালন নির্দিষ্ট হয়ে দাঁড়ায়। আর পুরুষেরা বরাবর শিকারের কাজে নিযুক্ত হয়। আরো পরবর্তীতে অবশ্য কৃষিকাজে পুরুষ-নারী উভয়ে হাত ধরাধরি করে শ্রম দেয়।

গুহাবাসী ভারতীয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল আগুনের আবিষ্কার। দাবানল ও আগ্নেয়গিরির আগুন থেকে তারা আগুনের ব্যবহার শেখে। এর ফলে শিকারী মানুষ কাঁচা মাংসকে আগুনে পুড়িয়ে খেত। মাটির পাত্র তৈরি করে রান্নার কাজে তারা আগুন ব্যবহার করে। মাটির পাত্র নির্মাণে তখনো তারা কুমোরের চাকার ব্যবহার শেখেনি বলা হয়। আগুনের ভয় দেখিয়ে তারা হিংস্র পশুকে তাড়িয়ে নিজেদের নিরাপত্তা বাড়ায়। আগুনের আবিষ্কার যেমন জীবনের নিরাপত্তা বাড়ায়, তেমনি প্রাথমিকভাবে প্রস্তর নির্মিত চাকার আবিষ্কার মানুষের জীবনকে গতিময় করে।

জলপথে যাতায়াতের জন্য ও পণ্য পরিবহনে কাঠের গুড়ি খোদাই করে নৌকা, ডিঙ্গি, ভেলা প্রভৃতি আবিষ্কার করে। সমাজে নারী-পুরুষের শ্রম বিভাজন তৈরি হয়। এইরূপ শিকারী গুহাবাসী মানব সমাজে মাতৃতান্ত্রিকতা প্রাধান্য পায় বলে গবেষকগণ মনে করেন। গুহার দেওয়ালে নানা চিত্রকলা ও ধর্মবিশ্বাসের নমুনা পাওয়া যায়। জাদু বিশ্বাস বা কোনো ধর্মীয় শক্তিকে তুষ্ট করে ভালো শিকার পাওয়া ও নিরাপদে ফিরে আসার আহুতি চিত্র পাওয়া যায়। ভারতে প্রাচীন প্রস্তর যুগের অবসান ঘটে আজ থেকে প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার বছর পূর্বে।

এই সংস্কৃতির অবলুপ্তির কারণ ছিল নির্দিষ্ট। ক্রমশ বন্যপশুর সংখ্যা হ্রাস, মানুষদের শিকারের অপ্রতুলতা, সেই সঙ্গে গৃহপালিত পশুপালনের প্রবণতা বৃদ্ধি। সর্বোপরি শিকারের মাধ্যমে খাদ্যের অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকিপূর্ণ জীবনের পরিবর্তে স্থায়ী কৃষিকাজের সূচনা। এই সকল কারণে ধীরে ধীরে মানুষ গুহাবাসী শিকারী জীবনের পরিবর্তে স্থায়ী গ্রামভিত্তিক কৃষিকেন্দ্রিক খাদ্য উৎপাদনকারী পর্যায়ে উন্নীত হয়।

Post Comment

You May Have Missed