টীকা লেখো: সতী ময়না ও লোরচন্দ্রাণী
টীকা লেখো: সতী ময়না ও লোরচন্দ্রাণী:
উত্তর: সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী দৌলত কাজীর একমাত্র রচনা। কিন্তু রচনাটি অসমাপ্ত থাকলেও এই একটি রচনাই কবিকে অমর করে রেখেছে।
হিন্দি কবি সাধনের ‘মেনাসত’ কাব্য অবলম্বনে দৌলত কাজী তাঁর ‘সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী’ কাব্য রচনা করেন। কাব্যটি কবির মৌলিক রচনা নয়, অনুবাদ। তবুও কাহিনী সংস্থান, চরিত্র চিত্রণ এবং শিল্পরীতি বা রচনারীতিতে কবি যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।
ড. মহম্মদ এনামূল হক ‘সতী ময়না ও লোরচন্দ্রানী’ কাব্যের কাহিনীকে তিন খণ্ডে ভাগ করেছেন। পরিচয় খণ্ড, বিরহ খণ্ড ও মিলন খণ্ড। প্রথম খণ্ডে কবি নায়ক-নায়িকার পরিচয় সূত্রের, তাদের বিবাহিত জীবনের ঘটনাবলী এবং দাম্পত্য জীবনের নিষ্ফলতা ও অতৃপ্তির আভাস দিয়েছেন। দ্বিতীয় খণ্ডে প্রধান নায়িকা ময়নাবতীকে বিরহের আগুনে দগ্ধ করে তাকে খাঁটি সোনায় পরিণত করেছেন। এই খণ্ডে ময়নাবতীর বিরহ ও বিরহিনী ময়নাবতীর প্রতি ছাতনের সহস্র প্রলোভনের কথা বিবৃত হয়েছে। এই দুই বিষয়কে উপলক্ষ্য করে কবির কবিত্ব সুধা ‘বারমাসী’ আকারে উৎসারিত হয়েছে। তৃতীয় খণ্ডে ময়নাবতীর সঙ্গে তাঁর স্বামী লোর ও সপত্নী চন্দ্রানীর মিলন ঘটে।
কবি বন্দনা অংশে নরবন্দনার মতো দুঃসাহস দেখিয়েছেন। কাব্যের আখ্যান ভাগ সংক্ষিপ্ত। আল্লাহ্ বা রসুলের প্রশস্তির সময়, রাজপ্রশস্তির সময় বা নায়িকার রূপ বর্ণনায় অথবা যুদ্ধের বর্ণনায় কবি যথেষ্ট সংযম দেখিয়েছেন। কাহিনীতে কবি বাঙালি মনন ও মেজাজে সমৃদ্ধ করেছেন। এখানেই কবি মধ্যযুগীয় কবি-শিল্পীদের চেয়ে উন্নত শিল্পবোধের পরিচয় দিয়েছেন।
রাজা ‘লোর’ এই কাব্যের মূল চরিত্র। সে ভোগী, কোনো নীতি আদর্শ নেই। পরস্ত্রী চন্দ্রানীর সৌন্দর্যের কথা শুনে তাকে পাওয়ার আশা করে। লোর চরিত্রের মধ্যে Doing আছে Suffering নেই। এজন্যে সে নায়ক হয়েও বড়ো চরিত্র নয়।
প্রতি-নায়ক ‘বামন’ বীর-পুরুষ কিন্তু নপুংসক। ‘বামন’ জীবনযুদ্ধে জয়ী হতে পারেননি। ‘ময়নাবতী’ই আদর্শ চরিত্র। স্বামী তার নিকট সর্বস্ব। রত্না-মালিনীর শত প্রলোভনেও সে প্রলোভিত হয়নি। ময়না সজীব চরিত্র, কিন্তু সক্রিয় চরিত্র নয়। ‘চন্দ্রানী’ কাব্যের সবচেয়ে সজীব ও সক্রিয় চরিত্র। বঙ্কিমচন্দ্রের অনেকগুলো উপন্যাসের নারী চরিত্রের মতোই চন্দ্রানী দৈহিক কামনা-বাসনা জর্জরিত রক্তমাংসে গড়া সাধারণ রমনী। ‘ছাতন’ রাজপুত্র কিন্তু লম্পট ও কামুক চরিত্র। সমাজের দুষ্ট ক্ষতের মতো সে যেখানে যায় সেই স্থানকেই কলুষিত করে। ‘রত্না-মালিনী’ চতুর, পরিপক্ক, বাষ্পটু। কাব্যে ‘রত্না’ এক উজ্জ্বল চরিত্র।
বর্ণনা রীতিতে কবির সংযমী মনোভাব, তাঁকে মধ্যযুগীয় গতানুগতিকতা থেকে স্বতন্ত্র মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। সংস্কৃত ও বাংলা মিশ্রিত ভাষা ব্যবহার করে দক্ষতা দেখিয়েছেন। ব্রজবুলি ভাষা ব্যবহারেও তিনি দক্ষ। পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দ ব্যবহার করেছেন। মধ্যযুগের প্রায় সব কবির কাব্যেই উপমা অলংকার ইত্যাদির প্রচুর ব্যবহার লক্ষণীয়। স্বতন্ত্রধর্মী বৈশিষ্ট্য হল, কবির হিতোপদেশমূলক বাণীর ব্যবহার। যেমন ‘কাণ্ডারীবিহীন নৌকা স্রোতে ভঙ্গ হয়।’
সতীময়না বা লোর চন্দ্রানী কাব্যের বিচারে বলা যায়, কাব্যখানি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে উচ্চমানের শিল্প সম্মত একখানি স্বতন্ত্রধর্মী রচনা। অসমাপ্ত হলেও এই একখানি কাব্যই কবিকে মধ্যযুগীয় কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী করেছে।