চর্যাপদের সাহিত্যমূল্য আলোচনা করো ২০২৪
চর্যাপদের সাহিত্যমূল্য আলোচনা করো 2024
উত্তরঃ চর্যাপদ বৌদ্ধসহজিয়া সিদ্ধাচার্যদের সাধনগীতি। সচেতনভাবে সাহিত্য সৃষ্টির উদ্দেশ্য চর্যাকারদের ছিল না। নিজেদের ধর্মের সাধনপদ্ধতি অন্য সম্প্রদায়ের কাছ থেকে গোপন রাখতে তাঁরা অভিপ্রায়িক ভাষার সাহায্য নিয়েছেন। যাতে তাঁদের সাধনপদ্ধতি নিজের সম্প্রদায়ের মধ্যে গোপন থাকে। মানুষের জীবনের বিচিত্র সুখ-দুঃখ ও আশা-নিরাশার কাহিনী নিয়ে সাহিত্য গড়ে ওঠে। চর্যাপদের বিষয়বস্তু ধর্মকেন্দ্রিক, দেহসাধনার গোপনতত্ত্ব চর্যার সমস্ত পদে প্রকাশ পেয়েছে। স্বভাবতই মনে হতে পারে চর্যাকাররা জীবনের কান্নাহাসির তরঙ্গ থেকে পলাতক, ফলে চর্যাপদের মধ্যে সাহিত্য খুঁজতে যাওয়া বৃথা।
কিন্তু মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর আদিযুগের সাহিত্য মাত্রই ধর্মকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে। বাইবেল, বেদ, উপনিষদ ও পুরাণে ধর্মভাব প্রবল কিন্তু সেগুলি রসের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। তেমনি চর্যাগীতির সাধন বিষয়ক রচনা হলেও মানবজীবনের সুখ-দুঃখের ভিত্তিতেই তার প্রতিষ্ঠা। চর্যাপদের কবিরা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপরসগন্ধময় জগৎকে এবং মানবজীবনের সুখ-দুঃখ মিলন-বিরহের লীলা বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করেননি। গভীর মতপ্রিীতি ও জীবন রসরসিকতা তাঁদের রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। রূপ ও অরূপ চর্যাগীতিতে একাকার হয়ে গিয়েছে। চর্যাপদের কবিরা ধর্মতত্ত্বের কথা বলতে গিয়ে সাধারণ মানুষের সমাজজীবন থেকে প্রতীক ও চিত্রকল্পাদি গ্রহণ করেছেন এবং তাঁদের রচনাগুলিকে জীবন রসসিক্ত করে তুলেছেন।
সাধনার গুঢ়তত্ত্ব ছাড়াও পদগুলির মধ্যে সামাজিক, ঐতিহাসিক ও সাহিত্য মূল্য বর্তমান। পদগুলির মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে বাংলার সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা, প্রকৃতিপ্রেম, মানবতা এবং সুললিত রাগরাগিনী সমৃদ্ধ সঙ্গীতের মূর্ছনা। চর্যাকাররা দীক্ষিত হওয়ার আগে গৃহী ছিলেন। সার্বিক জীবন দৃষ্টি সত্তা দিয়েই তারা জগৎ ও জীবনকে উপভোগ করেছিলেন। দণ্ড, পাখি, গাছকে যেমন দেখেছেন তেমনই ফুল-পাতা ময়ূরের পুত্র মাথায় গুঁজে শুল্লা ফুলের মালা দুলিয়ে পাহাড়ি পথে শবরীর পদচারণা দেখেছেন। এইসব বাস্তবচিত্র, সমকালীন জীবনের খণ্ডচিত্র একালের সাহিত্যপিপাসু মনকে সহজেই মুগ্ধ করে। কবি সাহিত্যিকদের মতো চর্যা রচয়িতারাও তাঁদের রচনায় প্রকৃতিকে ব্যবহার করেছেন
“ভবনই গহন গম্ভীর বেগে বাহী। দু-অন্তে চিখিল মার্কে ন থায়ী।।”
প্রায় প্রতিটি পদেই উপমা ও অলঙ্কারের সৌন্দর্যা, ছন্দ-নৈপুণ্য প্রকাশিত। কবিতাগুলির মধ্যে আধুনিক সনেটের লক্ষণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্যনীয়।
শান্ত পর্বত, স্রোতস্বিনী নদী, নারী পাটনী, পুলকিত জ্যোৎস্না, উজ্জ্বল মন্দির, সন্ধ্যার আরতির ঘন্টা, হরিণ শিকারের প্রয়াস, একতারা বাজিয়ে যোগীর চলা জীবনের এই সকল নানা চিত্রমালা ধর্মের সীমা অতিক্রম করে সৌন্দর্যলোক সৃষ্টি করেছে। কোথাও করুণাকে ডমরুধ্বনি, কোথাও জ্ঞানকে জ্যোৎস্না, কোথাও কোথাও কায়াকে নৌকারূপে কল্পনা করে চর্যাপদের কবিরা প্রাচীন লৌকিক জীবনকে অপূর্ব সাহিত্য-রসে মন্ডিত করে পরিবেশন করেছেন।-
উচা উঁচা পাবত তাঁহি বসই শবরী বালী। ” মোরঙ্গী পিচ্ছ পরহিণ শবরী গিবত গুঞ্জরী মালী।।”
অপূর্ব নিসর্গ চিত্রই অঙ্কিত হয়েছে সামান্য কয়েকটি শব্দের সংযোজনায়। পর্বত নন্দিনী, পার্বতী না শবরী বালিকা বসে আছে উচ্চ শৃঙ্গ চুড়ে। নিকষ কালো নিটোল স্বাস্থ্যবতী সে বালিকার গলায় গুঞ্জার মালার রক্তিম আভা অপূর্ব শোভায় বিকশিত। ময়ূর পুচ্ছের সাতটি রঙে তার রূপ উদ্ভাসিত। মিত ভাষণে এমন অপরূপ বর্ণনা সত্যই উচ্চাঙ্গের কবিকৃতির পরিচায়ক।
পরমার্থ তত্ত্বের বাহ্যিক রূপদান করতে গিয়ে ভুসুকুপাদ যেন বাংলায় গল্পের আমেজ
এনেছেন তাঁর অপরূপ পদের মূর্ছনায়
“অপণা মাংসে হরিণা বৈরী।
খনহ না ছাড়অ ভুসুক অহেরী।।”
নিজের মাংসের জন্যই হরিণ নিজের শত্রু। শিকারী ভুসুক সেজন্য ক্ষণেকের তরেও হরিণকে রেহাই দেয় না। হরিণী হরিণকে বন ছেড়ে পালিয়ে যেতে বললে তার পায়ের ক্ষুরও দেখা যায় না দ্রুত পদক্ষেপের জন্য।
দুঃখ প্রকাশের কাব্যের আবেদন যে সবচেয়ে বেশি, একথা চর্যার কবিরা জানতেন।
মেয়েদের দুঃখ প্রকাশের সর্বশেষ আশ্রয় তার মা। চর্যার কবিরা সেইরকম এক দুঃখি
নারীর চিত্র অঙ্কন করতে গিয়ে বলেছেন-
“ফেটলিউ গো মাত্র অন্তউড়ি চাহি।
জা এথু বাহাম সো এণু নাহি।।”
আমার প্রথম বাসনার ধন প্রসবের পরে যে আতুর খুঁজি- তা পাই না মাগো। আধ্যাত্মিক অর্থ যাইহোক, নারী জন্মের এই দুঃখানুভূতির তীব্রতা সহজেই পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করে যায়।
সামগ্রিকভাবে বিচার করলে চর্যাগীতির সাহিত্যমূল্য প্রাথমিকভাবে অস্তিত্বহীন বলে ধরা পড়ে। কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে বোঝা যায় চর্যাগীতিতে জীবনের রূপ সন্ধান একেবারে ব্যর্থ হয় না গৌড়ীয় বৈষ্ণব তত্ত্ব না জেনেও যেমন বৈষ্ণব পদাবলীর রস আহরণে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না। ঠিক তেমনি চর্যার ঈড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না ও সহজানন্দ তত্ত্ব না জেনেও বাইরের দিক থেকে চর্যাপদের রসবস্তু উপভোগ করা যায়।
চর্যার পদকর্তারা খরস্রোতা নদীর ছবি আঁকতে গিয়ে লোভ, মায়া, মমতা জড়িত অশান্ত-অস্থির ক্ষণস্থায়ী মানব জীবনকেই তুলে ধরেছেন। আবার হরিণ শিকারের কাহিনীতে পশুজীবনের অব্যক্ত মর্মযন্ত্রণার অভিব্যক্তির মধ্যে মুক্তিপিপাসু মানুষের কান্না ধ্বনিত হয়েছে। এইভাবে দেখা যায় চর্যাগীতিতে সহজ বাস্তব জীবনরস অপূর্ব মাত্রায় প্রকাশিত। ফলে চর্যাগীতির সাহিত্যমূল্য বা কাব্যমূল্য কখনোই উপেক্ষা করা যায় না। তাছাড়া বাংলা সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য যে ‘গীতিপ্রাণতা’, বাংলা সাহিত্যের জনমক্ষণে সেই ‘গীতিপ্রাণতা’ বৈশিষ্ট্য চর্যাগীতিতে প্রস্ফুটিত পুরোমাত্রায়।
এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চলে যে ধর্মঠাকুরের পূজা প্রচলিত, ধর্মঠাকুরের পরিকল্পনায় বৌদ্ধ তান্ত্রিক ধর্মের যথেষ্ট প্রভাব আছে। ধর্ম ও পূজা পদ্ধতি গ্রন্থ শূন্যপুরাণে চর্যাগীতির রূপক উপমার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। বাংলা সাহিত্যে চর্যার সুদুরপ্রসারী প্রভাব লক্ষ্যনীয়।। চর্যার অনুবৃত্তি দেখা যায় সপ্তদশ শতাব্দীর নাথ সাহিত্য ও বাউল গানে। চর্যার সহজিয়া জীবনপন্থী লোকসাহিত্যের প্রভাব বাংলা সাহিত্যের ক্রমবিকাশে ও পরিণতিকে করেছে শক্তিদান