সংক্ষিপ্ত টীকা লেখো: (ক) চন্দ্রাবতীর রামায়ণ, (খ) অদ্ভুত
উত্তর: (ক) চন্দ্রাবতীর রামায়ণ: কৃত্তিবাসী রামায়ণের প্রভাবে অনেক কবিই রামায়ণ অনুবাদ করেন। কৃত্তিবাসের পদাঙ্ক অনুসরণ করে শতাধিক কবি রামায়ণ রচনায় প্রয়াসী হন। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রখ্যাত ‘মনসামঙ্গল’ কাব্য রচয়িতা দ্বিজবংশী বা বংশীদাস চক্রবর্তীর কন্যা চন্দ্রাবতী গীতিকাব্যের আকারে রামায়ণ রচনা করেন। তিনি ময়মনসিংহ জেলার পাটওয়ারী গ্রামের অধিবাসী। বংশীদাস চন্দ্রাবতী ও তাঁর প্রণয়ী জয়চন্দ্রের সাহায্যে মনসার ভাসান গান রচনা করেছিলেন। দ্বিজবংশী সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগের লোক ছিলেন, সেহেতু তাঁর কন্যা চন্দ্রাবতীর কাব্য ঐ শতাব্দীর শেষভাগে রচিত হয়েছিল মনে করা হয়। এই রামায়ণের কোন লিখিত পুঁথি পাওয়া যায়নি।
চন্দ্রাবতীর রামায়ণ সম্পূর্ণভাবে খাঁটি নয়। ভাষা ও পদবিন্যাসে আধুনিকতার ছাপ আছে। চন্দ্রাবতীর রামায়ণ গীত, বিবাহ ও ক্রিয়াকর্ম উপলক্ষে গাওয়া হয়। গ্রন্থটি তিন ভাগে বিভক্ত হলেও অসম্পূর্ণ। কম বয়সের বিরহজনিত শোকে দুঃখে কাব্যটি শেষ করতে পারেন নি। মৈমনসিংহ গীতিকার একটি পালায় চন্দ্রাবতীর বিয়োগান্তক জীবন পরিচয় পাওয়া যায়। প্রথম যৌবনে এক যুবককে ভালোবেসেছিলেন। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতায় চন্দ্রাবতীর জীবন অন্ধকারে কালো হয়ে যায়। এছাড়াও ‘দস্যু কেনারামের পালা’ মৈমনসিংহে প্রচলিত আছে, তাতে চন্দ্রাবতীর কবি ব্যক্তিত্বকে একটা কাল্পনিক ব্যাপার বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
চন্দ্রাবতীর রামায়ণে ‘কুকুরা’ নামে একটি চরিত্র নূতন। চন্দ্রাবতীর রামায়ণের কোন পুঁথি পাওয়া যায়নি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন পুঁথি সংগ্রাহক মৈমনসিংহবাসী চন্দ্রকুমার দত্ত স্থানীয় মহিলাদের গলায় এই রামায়ণ গান শুনে সংগ্রহ করেন। সংগ্রহকারী গ্রাম্য গাথা ছড়া সংগ্রহের বিজ্ঞানভিত্তিক নিয়ম না জানায় এই রামায়ণ শুনে শুনে মনে হয় শহরে ছাপ পড়েছে। গ্রাম্য ভাবভাষাভঙ্গী সবই পরিবর্তিত করে সাহিতিক মূল্য কমে গিয়েছে।
(খ) অদ্ভুত রামায়ণ: চৈতন্যদেবের জন্মের পরে ষোড়শ শতাব্দীতে তেমন শক্তিমান কবি প্রতিভার অনুপস্থিতির দরুন রামায়ণ এবং ভাগবত অনুবাদ খুবই কম হয়েছে। শ্রীচৈতন্যদেবের রাধা-কৃষ্ণ প্রেমবন্যায় সবই ভেসে গিয়েছে। এরমধ্যে যে কয়জন অনুবাদক এই কাজে প্রয়াসী হয়েছিলেন তাদের মধ্যে একজন হলেন উত্তরবঙ্গের রামায়ণ অনুবাদক অদ্ভুত আচার্য। তাঁর আসল নাম নিত্যানন্দ আচার্য। পাঁচ বছর বয়সে রামচন্দ্র স্বয়ং কবির সামনে এসে হাতের তীর দিয়ে কবির জিভে রাম নাম লিখে দেন আর রামায়ণ রচনার আদেশ দেন। খুব অল্প বয়সেই তাই এই অনুবাদ কর্ম তিনি সম্পাদন করতে পেরেছিলেন। ১৯১৩ সালে রজনীকান্ত চক্রবর্তীর সম্পাদনায় অদ্ভুত আচার্যের রামায়ণের আদি খণ্ড প্রকাশিত হয়। বগুড়া বা রাজসাহী জেলার কোন গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর জন্ম ১৬৪৭
গ্রীষ্টাব্দে। মূল সংস্কৃত রামায়ণের সঙ্গে অদ্ভুত রামায়ণের বিশেষ কোন সম্পর্ক নেই। তাঁর সাত কাণ্ড রামায়ণের রচনারীতি পরিষ্কার ও সুখপাঠ্য। করুণরস ও গভীর আবেগের বর্ণনায় সজল ও সরস করে তুলেছেন। কৃত্তিবাসের সমকক্ষ না হয়েও তিনি আপন প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।