শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্যের অভিনবত্ব বিশ্লেষণ করো।
উত্তর: মহামুনি বেদব্যাস অষ্টাদশ পুরাণের রচয়িতা বলে বিখ্যাত। ‘ভাগবত’-এই আঠারোটি পুরাণের অন্যতম। মালাধর বসু এই সংস্কৃত ভাগবত পুরাণের বঙ্গানুবাদ করেন। তবে তিনি সম্পূর্ণ অনুবাদ না করে দশম ও একাদশ স্কন্দেরই অনুবাদ করেন। তাঁর এই অনুবাদ কাব্যের নাম ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’। ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ মালাধর বসুর পাঁচালি আকারে রচনা। উদ্দেশ্য ছিল লোক সাধারণের
সুর করে গান করা, তা হলে গানের মাধ্যমে সহজেই ভাগবতের বাণী জনতা গ্রহণ করতে পারবে। দুরূহ ভাগবত যাতে সহজবোধ্য আকারে অসংস্কৃতজ্ঞ লোকসাধারণের মধ্যে প্রচারিত হবে। কবি মূল ভাগবতের তত্ত্বকথার অংশকে যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত করে বর্ণনা ও আখ্যানকে সম্প্রসারিত করেন। প্রয়োজনবোধে মূল অংশের কিছু পরিবর্তন এবং অতিরিক্ত কিছু কাহিনীও অনুবাদে যোগ করেন। খগেন্দ্রনাথ মিত্রের মতে, কৃষ্ণলীলাকে মালাধর বসু ‘বাঙালির ছাঁচে ঢালিয়া সাজাইয়াছেন।’
মালাধরের কাব্যে বাঙালির কৃষ্ণভক্তির প্রাক্-চৈতন্য ঐতিহ্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এই কাব্যে সর্বপ্রথম কবি শ্রীকৃষ্ণকে ‘প্রাণনাথ’ বলে সম্বোধন করেছেন। বাঙালিয়ানা শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্যের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ভাগবতের কাহিনী উত্তর ভারতের আর্যসমাজের কাহিনী। যে কাহিনীর সঙ্গে বাঙালির কোনো যোগাযোগ নেই। কিন্তু
শ্রীকৃষ্ণবিজয়ে বৃন্দাবনের যে প্রাকৃতিক পরিবেশ অঙ্কিত হয়েছে তাতে বাংলাদেশের আম-জাম-কাঁঠাল-সুপারি বনের দীর্ঘ ছায়া ঘনীভূত। কৃষ্ণের বাল্যলীলা বাঙালি বালকের জীবনলীলা।
কাব্যটিতে আন্তরিক ভক্তিভাবুকতা শ্রীচৈতন্যদেবকে আকৃষ্ট করেছিল। তুর্কী আক্রমণে বিধ্বস্ত সমাজের বাঙালির ভীরুতা ও দুর্বলতাকে দূর করবার জন্যে এবং বাঙালির চিত্তে সাহস সঞ্চারের জন্য এরূপ একটি বীররসাত্মক কাব্যের প্রয়োজন ছিল। পৌরাণিক বিষয় নিয়ে কাব্য রচনা করেও মালাধরের স্বজাত্যপ্রীতি কত গভীর ছিল তার প্রমাণ ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’।
শ্রীকৃষ্ণবিজয়ে রাধার নাম সর্বত্র উল্লিখিত হয়নি। অনেক স্থানে ‘একনারী’ উল্লেখ হয়েছে। এই কাব্যে বড়াই চরিত্র নেই। চন্দ্রাবলী ও রাধা এই কাব্যে এক ব্যক্তি নয়। শ্রীকৃষ্ণবিজয়ে কৃষ্ণ চরিত্রে ঐশ্বর্যের সত্যকার প্রকাশ। শ্রীকৃষ্ণবিজয়ে কোনো খণ্ডবিভাগ নেই। মহাপ্রভুর অন্তরনিষিক্ত শ্রদ্ধাঞ্জলিই এবং কাব্যের রচনারীতি মালাধর বসুকে বাংলা সাহিত্যে অমরত্ব দান করেছে।