শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের আবিষ্কার, প্রকাশ, রচনাকাল, রচনাবৈশিষ্ট্য। উজ্জাখ করে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এর গুরুত্ব বিশ্লেষণ করো 2024
উত্তরঃ চর্যাগীতির পর দীর্ঘ আড়াইশ বছরকাল বাংলা সাহিত্যে সেরূপ উল্লেখযোগ্য। কোনো সৃষ্টি দেখা যায় না। ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীতে বাংলায় সেরূপ কিছু সাহিত্যও সৃষ্টি হয়নি। সমালোচকরা তাই এই সময়কে “অন্ধকার যুগ” বলেও অভিহিত করেন। তুর্কি আক্রমণ ও আধিপত্য শুরুর সময়ে বাংলার রাষ্ট্রিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ভয়ানক বিপর্যয় ঘটে; সেই তুর্কি আক্রমণের পরবা অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য’। জীবনের কাহিনীকে
১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে বাঁকুড়া জেলার বেলিয়াতোড় গ্রামের অধিবাসী পণ্ডিত বসন্তরঞ্জন রায় ঐ জেলারই কাঁকিল্যা গ্রাম থেকে একটি বহু প্রাচীন পুঁথি আবিষ্কার করেন। শ্রীনিবাস আচার্য মহাপ্রভুর দৌহিত্র বংশধর দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের গোয়ালঘরের মাচার উপর ধামায় একরাশ পুঁথির মধ্যে এই গ্রন্থের পুঁথিটি আবিষ্কার করেছেন। পুঁথিটির প্রথম, মধ্য ও শেষের দিকে কিছু পৃষ্ঠা পাওয়া যায় নি। কৃষ্ণলীলা বিষয়ক কাব্য বলেই আবিষ্কারক নাম দেন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। পুঁথির মধ্যে ১০৮৯ সনের একটা চিরকুট ছিল সেখানে কাব্যটিকে ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ’ (শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ব) বলা হয়েছে, লেখক-জনৈক বড়ু চণ্ডীদাস। বসন্তরঞ্জন রায় গ্রন্থটিকে সম্পাদনা করে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ’ থেকে ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নাম দিয়ে প্রকাশ করেছেন।
‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাহিনীকাব্য, জয়দেব পরবর্তী রাধাকৃষ্ণবিষয়ক প্রণয়কাহিনী। পুঁথির প্রাচীনতা হেতু রচনাকাল নির্ণয়ে কিছুটা অসুবিধা দেখা দেয়। যদিও পুঁথিটির গুরুত্ব অনেক বেশি। এর ভাষা প্রাচীনতম বাংলা ভাষা। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পুঁথি প্রাচীন বাংলার পাণ্ডুলিপি। কাব্যে প্রণয় কাহিনীর মধ্যে পৌরাণিক প্রেক্ষাপট স্থাপিত হয়েছে, তবে লোকজনের আদর্শ, স্থূল রীতি, গ্রাম্যতা ও ক্লেদক্লিন্নতা বেশী প্রকাশ পেয়েছে। রাধা-কৃষ্ণ-বড়াই-এই তিনজনের উক্তি-প্রত্যুক্তির মাধ্যমে কাহিনীর পরিণতি ঘটেছে। স্কুল রসরুচির গ্রাম্য গালিগালাজের মধ্যে মর্ত্যজীবন পিপাসা ও প্রাণরসে ভরা এই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য।
কাহিনী সর্বমোট তেরটি খণ্ডে বিন্যস্ত। শেষ অংশের নাম ‘রাধাবিরহ’। শেষের অংশটিতে খণ্ড নাম নয় বলে একে অনেকেই প্রক্ষিপ্ত মনে করেন। জন্ম খণ্ড, তাম্বুল খণ্ড, দান খণ্ড, নৌকা খণ্ড, ভারখণ্ড, দূত খণ্ড, বৃন্দাবন খণ্ড, বস্ত্রহরণ খণ্ড, কালীয়দমন খণ্ড, হারখণ্ড, বানখণ্ড, বংশীখণ্ড, রাধাবিরহ-এতগুলি খণ্ডে বিভক্ত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’।
রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা ‘শ্রীকৃষ্ণকর্তন’-এর মূল উপজীব্য বিষয়। কবি বিষ্ণুপুরাণ, ভাগবতকে অনুসরণ করেছেন। কবি বড়ু চণ্ডীদাস জীবনরসিক ছিলেন বলেই কল্পনায় কিছু লৌকিক লীলার প্রভাব পড়েছে।
বাংলা সাহিত্যে কৃষ্ণকথা প্রচারের আদি কবি বড়ু চণ্ডীদাস। বাংলা ভাষায় রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক প্রথম কাব্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এটাই মধ্যযুগের আদি রচনা। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে ভূভার হরণের জন্য শ্রীবিষ্ণু কৃষ্ণরূপে মর্ত্যে নেমে এসেছিলেন। কাব্যটিতে রাধা ও কৃষ্ণের প্রণয়, পরস্পরের রাগ-অনুরাগের মধ্যে মনুষ্য স্বভাবধর্ম বড়ো হয়ে উঠেছে। কাব্যে আখ্যায়িকা, নাট্যরস ও গীতিরসের সমন্বয় ঘটেছে। রাধা-কৃষ্ণ-বড়াই-এর উক্তি- প্রত্যুক্তি ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিয়েই কাব্য গড়ে উঠেছে। পৌরাণিক কাহিনীকে কবি বড়ু চন্ডীদাস প্রত্যক্ষ লোকায়ত জীবনরসে সিক্ত করে আমাদের কাছে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যরূপে পরিবেশন করেছেন।