‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের নামকরণ ও সাহিত্যিক গুরুত্ব নিরূপণ করো।
উত্তর: তেরটি খণ্ডে বিন্যস্ত রাধাকৃষ্ণের প্রণয়কাহিনী নিয়ে রচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য। বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ মহাশয় প্রাচীন পুঁথিটি ১৯১৬ খ্রীষ্টাব্দে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ’ থেকে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নাম দিয়ে সম্পাদনা করেন। গ্রন্থের নাম নিয়ে অনেক রকম মতামত প্রকাশ হয়েছে। কেউ কেউ এই কাব্যের নাম ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ’ দিতে চান। তাঁদের যুক্তি, যে পুঁথি পাওয়া গিয়েছিল তার মধ্যে কয়েকটি লাইন লেখা চিরকুট পাওয়া যায়। সেখানে কোন এক শ্রীকৃষ্ণ পঞ্চানন ঐ পুঁথির ১৬ পাতা ১০৮৯ সনে অর্থাৎ ১৬৮২ খ্রীষ্টাব্দে চেয়ে নিয়ে কিছুদিন পর ফেরত দেন। ঐ লেখায় পুঁথিটিকে ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ’ পুঁথি বলে উল্লেখ করেছেন। তুলট কাগজের চিরকুটে লেখা ছিল ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ব্ব’। অর্থাৎ ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ-ই আধুনিক কালে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নামে পরিচিত।
বসন্তরঞ্জন তাঁর জীবৎকালে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এর শেষ সংস্করণে (১৩৫৬) ভূমিকায় লিখেছিলেন, ‘পুঁথির সহিত প্রাপ্ত স্মারকলিপি হইতে অনুমান হয় লীলাকীর্তনের এই অপূর্ব সামগ্রীটি ২৫০ বর্ষ পূর্বে বিষ্ণুপুর রাজ-পুঁথি-শালার সম্পত্তি ছিল, কোন প্রকারে উহা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর পুঁথির সহিত জড়াইয়া গিয়া থাকিবে।’
পুঁথির আখ্যাপত্র নষ্ট হওয়ার জন্য কাব্যের নাম, রচনাকাল, পুঁথি নকলের সন তারিখ কিছুই জানা যায় নি। যদিও চণ্ডীদাস কবির নামে আমরা কোন আখ্যানকাব্যের নাম শুনি নি। তাই সম্পাদক যে নাম দিয়েছেন সেটাই স্বীকার করে নিতে হবে।
কবি মুকুন্দ চক্রবর্তী ও ভারতচন্দ্রকে ছাড়লে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে তেমন সৃষ্টিকার কই? ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যটি রাধা-কৃষ্ণের প্রণয়লীলা নিয়ে রচিত বাংলা ভাষায় লেখা মধ্যযুগের প্রথম কাহিনীকাব্য। রাধা-কৃষ্ণ প্রেমলীলা সমন্বিত যে বৈষ্ণব সাহিত্য গড়ে উঠেছে তার পথিকৃৎ বড়ু চণ্ডীদাস। তবে এর আগে জয়দেব রাধাকৃষ্ণলীলা বিষয়ে সংস্কৃতে লিখেছেন ‘গীতগোবিন্দ’। কাব্যের উৎসে পৌরাণিক ভাগবত এবং সমকালীন লৌকিক জীবনধারা আছে। প্রকৃত জীবনচেতনা, মানবতাবাদ, ছন্দ-অলংকার, ভাষার দিক থেকে কাব্যটির কাব্যমূল্য অপরিসীম। নিসর্গ সৌন্দর্য, বিরহবেদনা প্রভৃতি অভিব্যক্তিতে বড়ু চণ্ডীদাস অসাধারণ কবিত্বশক্তি দেখিয়েছেন। রাধা-কৃষ্ণ-‘বড়াই-এর উক্তি’-প্রত্যুক্তিতে উন্নত নাট্যধর্মের ব্যঞ্জনা মেলে। অনেকে কাব্যটিকে কুমুর জাতীয় লৌকিক নাট্যরীতির প্রাচীন নিদর্শন বলেন। এখানে আমাদের কৃষ্ণযাত্রার কথা মনে পড়ে যায়। আখ্যায়িকা-গীতিকাব্য ও নাট্যরসের মিশেলে এক অভিনব কাহিনী। বিষয়বস্তু পৌরাণিক ও লৌকিক উপাদানের মিশ্রণে লিখিত। কবি এগারো বছরের কিশোরী রাধাকে একটু একটু করে নায়িকায় পরিণত করেছেন।
প্রমথনাথ বিশী মহাশয় বলেছেন, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের যেখানে শেষ, সেখান থেকে বৈষ্ণবপদাবলীর রাধার যাত্রা শুরু।’ নারীহৃদয়ের বিরহের দহন জ্বালার সঙ্গে কবি
প্রকৃতিকে মিলিয়ে দিয়েছেন। ‘রাধাবিরহ’-তে ‘চতুর্মাস্যা’ বর্ণনায় কালিদাসকে যেন গ্রহণ করেছেন। বৈষ্ণব পদাবলীর কয়েকটা পদে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধাবিরহ-এর দ্বিতীয় পদের হুবহু অনুসরণ দেখা যায়। তবে কিছু ত্রুটিও দেখা যায়। কারণ গ্রন্থ লেখার সময়ের পরিবেশ স্কুল ছিল। তবুও কাব্যটি উল্লেখযোগ্য বৈষ্ণবকাব্য।