মালাধর বসুর জন্ম, বংশ পরিচয় ও তাঁর কবিকৃতির বর্ণনা করো।
উত্তর: বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের সৃষ্টির মধ্যে মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ উল্লেখযোগ্য। মালাধর বসুর আবির্ভাবকাল সম্পূর্ণ স্পষ্ট নয়। মালাধর বসুর কাব্যসংখ্যা বেশি নয় তাই তাঁর আত্মপরিচয়ও বেশি পাওয়া যায় না। বর্ধমানের কুলীনগ্রামে কবির জন্মস্থান। পিতা ভগীরথ, মাতা ইন্দুমতী, পুত্র সত্যরাজ খান এবং পৌত্র রামানন্দ। এই রামানন্দ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর একজন ভক্ত এবং পার্যদ ছিলেন। কবির জন্মস্থান কুলিন গ্রামে প্রতিষ্ঠিত একটি বৃষ মূর্তি থেকে নিশ্চিতভাবে বলা যায় কবি ১৫শ শতাব্দীর তৃতীয় বা চতুর্থ দশকের সময়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কাব্যের রচনাকালে কবি জানিয়েছেন-
‘তেরশ পঁচানই শকে গ্রন্থ আরন্তন।
চতুৰ্দ্দশ দুই শকে হইল সমাপন।।’
১৪৭৩ খ্রীষ্টাব্দে কবি গ্রন্থ রচনা শুরু করেন এবং ১৪৮০ খ্রীস্টাকে কবির ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ গ্রন্থ সমাপ্ত হয়। ভাগবত সাত্ত্বিক পুরাণের অন্তর্গত ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’। ১২টি স্কন্দ, ৩৩৫ টি অধ্যায়, ১৮০০০ শ্লোক নিয়ে ভাগবত পুরাণ সৃষ্টি হয়েছে। ভাগবত পুরাণ রচনা করেছেন ব্যাসদেব। ব্যাসদেবের কাছে ভাগবত আখ্যান শুনেছেন তাঁর পুত্র শুকদেব। ভাগবতে বৈধিভক্তির আদর্শ কবি প্রচার করেছেন। কৃষ্ণের বৃন্দাবন, মথুরা এবং দ্বারকালীলা কবি শিল্পসম্মতভাবে প্রকাশ করেছেন।
ভাগবতের দশম স্কন্দের ১০টি অধ্যায়ে কৃষ্ণলীলা প্রাধান্য লাভ করেছে। কৃষ্ণ অবতারের কারণ থেকে যদুবংশের আখ্যান পর্যন্ত বর্ণিত হয়েছে। ভাগবতের একাদশ স্কন্দের বিষয়ও কৃষ্ণকে কেন্দ্র করে নানাভাবে আবর্তিত হয়েছে। ভাগবতে কৃষ্ণ ভগবান। দৈত্যরাজাদের ভারে পীড়িত পৃথিবী ব্রহ্মার কাছে ভারমুক্ত করার প্রার্থনা জানালে পৃথিবীকে রক্ষা করতে যাদব বংশের বসুদেবের সন্তানরূপে কৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটে। যদুবংশ ধ্বংস হবার পর আপন কাজ শেষ করে কৃষ্ণ স্বর্গে ফিরে যান।
‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ মূলত ভাবানুবাদ। ভাগবতের বহু শ্লোককেই মালাধর নিজস্ব রীতিতে পরিবেশন করেছেন। অনেক আখ্যান মালাধর বর্জন করেছেন। বাঙালি মানসের কথা চিন্তা করে কবি কাব্যটি রচনা করেছেন। ভাগবতে কৃষ্ণের আবির্ভাবে ঐশ্বরিক মহিমা গুরুত্ব পেয়েছে। ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ গ্রহণ, বর্জন ও নিজস্ব কল্পনাশক্তিতে কবি কাব্য গুণান্বিত করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। কেদারনাথ ভক্তিবিনোদ সম্পাদিত ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্য প্রথম মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হয় ১৮৮৬-৮৭ খ্রিস্টাব্দে। খগেন্দ্রনাথ মিত্রের সম্পাদনায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ মুদ্রিত হয়ে ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়।
সাধারণভাবে ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কথার অর্থ হল শ্রীকৃষ্ণের লীলা বা শোভাযাত্রা। গোটা কাব্যে শ্রীকৃষ্ণের লীলা মাহাত্ম্য প্রচারিত হয়েছে। বলা যায়, কাব্যটি শ্রীকৃষ্ণের বিজয়গাথা। ঐশ্বর্য ভাবের মধ্যে দিয়ে কৃষ্ণ যে জগতকে জয় করেছেন বিজয় কথাটির মধ্যে তার ইঙ্গিত মেলে। অত্যাচারিত দানবদের দলন করতেই কৃষ্ণের মর্ত্যলীলা। সেদিক থেকে ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ নামটি উপযুক্ত। তিন খণ্ডে বিভক্ত কাব্য- বৃন্দাবনলীলা, মথুরালীলা, দ্বারকা লীলা। কাব্যে কৃষ্ণের বীরত্বগাথা গাওয়া হয়েছে কাব্যটিতে ছন্দের বৈচিত্রা নেই। সহজ আন্তরিকতা ও ভক্তিভাবই কাব্যটিকে মর্যাদার আসনে বসিয়েছে।