‘ভারতচন্দ্র যুগসন্ধির কবি’- আলোচনা করো।
উত্তর: রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের মঙ্গলকাব্য রীতিতে লেখা ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য। মধ্যযুগের কবি হয়েও তিনি মধ্যযুগীয় ছিলেন না। হুগলী জেলার ভুরশুট পরগণার পেঁড়ো গ্রামে ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে জন্ম নেন। বাবা নরেন্দ্র রায়। জমিদারী বংশের সন্তান কিন্তু বর্ধমান রাজের বিরুদ্ধতায় বিষয় সম্পত্তি হারান। চৌদ্দ বছর বয়সে বিয়ে করে ত্যাজ্যপুত্র হন। বহু ক্লেশের পর নবদ্বীপরাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভাসদ পদ লাভ করেন। কৃষ্ণচন্দ্রের নিকট থেকে রায়গুণাকর উপাধি পেয়ে তাঁরই নির্দেশে ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য রচনা করেন।
শ্রীচৈতন্যের মানবধর্ম সাধনার ফলে রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বিলীন হয়ে যায় প্রাচীন মূল্যবোধ। হিংসা, অত্যাচার, অবিচারে সমগ্র সমাজ হল আকণ্ঠ নিমজ্জিত। সাধারণ মানুষ হয়েছিল অপাঙ্ক্তেয়। নারীকে পণ্য রূপে দেখা হত। এই যুগে পূর্বের সাহিত্য ধারাগুলি গতানুগতিক ও নিষ্প্রভ হয়ে গিয়েছিল এবং সমাজের আসন্ন রাজনৈতিক পরিবর্তনের আভাস সাহিত্যে ধীরে ধীরে প্রতিফলিত হয়েছিল। ষোড়শ থেকে সপ্তদশ শতাব্দীতে বাঙলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবন মোটামুটি মুসলমান শাসনে সুরক্ষিত ছিল। মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়নি, হিন্দু-মুসলমান সংস্কৃতি ঐক্যবদ্ধ ছিল। মানুষের ধর্মবিশ্বাস, শিল্পচর্চা, সাহিত্য ও কলাসাধনা তাই সংহত ছিল। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীতে সামাজিক জীবনের নিরাপত্তা যেমন বিঘ্নিত হল, ধর্ম বিষয়েও তেমনি অলৌকিকতার স্থানে বাস্তবতা, পারত্রিকতার স্থলে ঐহিকতা, অন্ধ সংস্কারের স্থলে বিদ্রূপাত্মক মনোভাব এই পর্বের কবিদের মধ্যে ধীরে ধীরে মাথা তুলেছিল। মঙ্গলকাব্যের কবিরা মঙ্গলকাব্য রচনাপ্রথা অনুসরণ করে মঙ্গলকাব্য রচনা করেছেন বটে, কিন্তু সেই প্রাচীন বিশ্বাস পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। দেবতার প্রজাদেশদানের ওপর তাদের আস্থা পূর্বের তুলনায় অনেক স্তিমিত হয়েছে। ভারতচন্দ্রের কাব্যে এই যুগলক্ষণের সর্বাধিক পরিচয় পাওয়া যায়।
অন্যদিকে এই যুগে গোষ্ঠী শাসন শিথিল হয়ে মানুষের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের জন্ম দিয়েছে। দেশের সর্বত্র অরাজকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। মহামারী মন্বন্তরে গ্রামগুলি শ্মশানে পরিণত হয়েছে। কেন্দ্রীয় শাসনের অব্যবস্থার সুযোগে স্থানীয় ভূস্বামী শাসকদের পীড়ন বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা বিপন্ন হয়েছে। ধনীর সম্পত্তি ও বিত্তবানদের বিত্ত রক্ষার ব্যাপারে দুর্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই অসহায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থায় মানুষরা নূতন ধর্ম-প্রেরণা অনুভব করেছিল। পূর্ব যুগের বৈষ্ণব ধর্ম, তার কোমল মাধুর্য্য অতিরিক্ত বিনয়পরায়ণতা ও বিগলিত প্রেমভক্তি নিয়ে মানুষের বর্তমান সামাজিক প্রয়োজন মেটাতে পারল না।
তাই একালের মানুষ নতুন করে শক্তি সাধনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিল। মঙ্গলকাব্যের দেবদেবীরা নিজেদের মাহাত্ম্য প্রচারের উৎকট স্বার্থে মানুষকে দুর্ভাগ্যের ক্রীড়নকে পরিণত করেছিল। শাস্ত্রে বিশ্বাসী দাম্ভিক আত্মবিশ্বাসে তারা অন্য ধর্মমত বা দেবতার উপাসনা সহ্য করতে পারেনি। দেবতাদের ঈর্ষা, দ্বেষ,প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও স্বার্থবুদ্ধি মানুষকে সন্দিগ্ধ করে তুলেছিল। এযুগের ভক্তের দৃষ্টিতে দেবতা সমগ্র বিশ্বের জননী। রামপ্রসাদের মতো ভারতচন্দ্রও যুগসচেতন কবি। তিনিও পুরাতনকে নামমাত্র গ্রহণ করে নূতনত্বের উদ্বোধন ঘটিয়ে মঙ্গলকাব্যের ধারায় নতুন জীবনের বার্তাবাহী। তাঁর কাব্যে শিব, অন্নপূর্ণা, মেনকা বাঙালি ঘরের মানুষ। তিনি শিশুদের দিয়ে মহাদেবের গায়ে ধূলি লেপন করেছেন
“কেহ বলে নাচ দেখি গাল বাজাইয়া। ছাইমাটি কেহ গায় দেয় ফেলাইয়া।।”
দেবতার গায়ে ধূলামাটি দিয়ে বাংলা কাব্যে আধুনিকতার শুরু। ঈশ্বরী পাটনী
‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’ বলে যখন, তখন আমাদের সেই বাঙালির চিরন্তন আশা-আকঙ্ক্ষা ও অকৃত্রিম স্নেহকেই প্রকাশ করে। কবি পুরাতন যুগের অন্তঃসারশূন্যতাতে আঘাত হেনে ভাবীকালের নবজীবনের যাত্রাপথকে দেখিয়েছেন। তিনি নাগরিক প্রথম আধুনিক কবি, তাই বলা যায় তিনি যুগসমাপ্তির ঘোষণা করে যুগাতিক্রমী ভিন্ন আদর্শের বার্তা নূতন দিনের মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।