বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বলতে কী বোঝো? সাহিত্যের ইতিহাস ইতিহাস থেকে কতটা স্বতন্ত্র তা আলোচনা করো।
অথবা, “সাহিত্যের ইতিহাস অনুমান কল্পনাবিলাসী সাহিত্য নয়, অসংহত পুরাতত্ত্ব পঞ্জীও নয়-সাহিত্য এবং ইতিহাস আলোচনা করো।
উঃ সাহিত্যের ইতিহাস নিছক সাহিত্য অথবা নিছক ইতিহাস নয়-সাহিত্য এবং ইতিহাস। প্রধানত সাহিত্যিক জিজ্ঞাসা এবং অনুসন্ধিৎসাই সাহিত্যের ইতিহাসকে জন্ম দিয়েছে।
ইতিহাস বলতে আমরা বুঝি: ‘ইতিহাস অর্থে প্রথমে প্রাচীন গল্প লোককথা, তথ্যপঞ্জী ইত্যাদির কথাই মনে করা হত। তারপরে সেই পুরাতন অর্থ ধীরে ধীরে বিবর্তিত ও পরিবর্তিত হয়েছে। প্রাচীন ভারতে ইতিহাস অর্থে একদা দেবাসুরের যুদ্ধ বর্ণনাদি উপাখ্যান মাত্রকেই বোঝানো হত।” পরে ইতিহাস অর্থে বোঝানো হয়েছে “লোক ক্রমাগত কথা”। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, “ধর্ম অর্থ
কামামোক্ষ এর উপদেশ সমন্বিত কথাযুক্ত পুরাবৃত্তই ইতিহাস।” “The shorter Oxford English Dictionary’-তে ইতিহাস শব্দের অর্থ করা হয়েছে-History in its broadest sense, is the strory of man’s past. More Specially it means the record of that past, not only in chronicles and treaties on the past, but in all sorts of forms. এই অর্থকেই একান্তভাবে স্বীকার করে নিলে সাহিত্যের জগৎ থেকে ইতিহাসের প্রচুর উপাদান
সংগ্রহ করা যেতে পারে। কিন্তু সময় যতই এগিয়েছে ইতিহাসের অর্থও পরিবর্তিত হয়েছে, ততই সাহিত্যের ইতিহাস আলোচনায় এক নবতর সাহিত্যিক প্রয়োজনবোধও গড়ে উঠেছে দিনে দিনে। সাহিত্যের ইতিহাস চর্চায় সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তার কথা ব্যক্ত হয়েছে Encyclopaedia Britannica গ্রন্থে। সাহিত্য জীবনের কথা বলে, জীবনের মূলগত বিশেষত প্রয়োজনের বৃত্তেই সাহিত্য, সকল রকম চারুশিল্পের সৃজন বাসনার জন্ম দেয় সাহিত্য, জীবনের মূলগত প্রাণশক্তির অনিবার্য প্রেরণাবশেই কালে কালে তার গতিপ্রকৃতি ও আকৃতি প্রকৃতি-কেবলই বিবর্তিত হয়ে হয়ে নবায়মনিতা। লাভ করেছে। এই বিবর্তনের ফলে মানুষের জীবন ভাবনা, তথা সৃজন প্রেরণার অন্তঃস্বভাব এবং বহিঃপ্রকাশের নানা বিবর্তন ও পরিবর্তন ঘটেছে।
ইতিহাসের স্বভাবধর্ম: অতুলচন্দ্র গুপ্ত বলেছেন, “মানুষ জীবনের টানে এগিয়ে চলে, সৃষ্টির প্রেরণায় নূতন সৃষ্টি করে। ইতিহাস জীবনের এই সৃষ্টি লীলার দর্শক।”
অর্থাৎ জীবন ঐতিহ্যের অনুবর্তনই ইতিহাসের একমাত্র লক্ষ্য। পূর্বাপর সম্পর্কের ঐতিহ্যাগত ক্রমবিকাশমান চরিত্রই ইতিহাসের সংহত অখণ্ড মূর্তি, গড়ে তোলে।
সাহিত্য ইতিহাসের কর্তব্য: প্রথমত ‘পুরাবৃত্ত বা প্রাচীন তথ্যপন্থীর উদ্ধার, উদ্ভাবন, অথবা আবিষ্কার’। দ্বিতীয়ত আবিষ্কৃত ও তথ্যদির প্রমাণ অনুসরণে বিশেষ বিশেষ ঐতিহ্যের কালগত বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করা এবং সেই বৈশিষ্ট্যের পরম্পরা অনুযায়ী বিবর্তনের ভাব ও রূপগত স্বভাব সন্ধান। তথ্যসংগ্রহ: পূর্বাচার্য গাজন নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও অক্লান্ত পরিশ্রম করে বাঙালি ঐতিহ্যের তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এপ্রসঙ্গে গুপ্ত কবি ঈশ্বর গুপ্তের কথা মনে করা যেতে পারে যিনি এই মহৎ সাধনার অন্যতম উল্লেখযোগ্য পথিকৃৎ।
ঐতিহ্যের কালগত বৈশিষ্ট্য নির্ণয় বাংলা সাহিত্যের বাঙালি ঐতিহ্যের রত্ন আবিষ্কারের পর বাঙালি ঐতিহ্যের অনুসন্ধানের চেষ্টা সেভাবে সফল হয়নি। ফলে ঐতিহ্য পরিচয়ের অভাবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস দুর্লভ হয়েছে। দীর্ঘ দিনের অনবধানের ফলে বাঙালি ঐতিহ্যের স্বতন্ত্র চরিত্রটি আজ আমাদের কাছে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। তাই দুর্বল কল্পনার জটিল গ্রন্থ ভেদ করে বাংলা সাহিত্য তাঁর নিজস্ব রূপ মহিমায় আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হতে পারে অল্পই। ফলকথা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বিশুদ্ধ বাঙালি জীবন ঐতিহ্যের ধারক, বাহক এবং পরিচায়ক। ইতিহাস সাহিত্যের বিবর্তনের পথে সংস্কৃত
কিংবা ইংরেজি প্রভৃতি ভাষা সাহিত্যের যোগাযোগের প্রাসঙ্গিক উপকরণ হয়ে উঠেছে। বাংলা এবং সাহিত্য আর্য ভারতীয় ভাষাসমূহের বংশপঞ্জী বিচার করলে দেখা যাবে বাংলা ভাষা জন্মসূত্রে প্রত্যক্ষত ‘প্রাকৃত’ ভাষা সাহিত্যের সঙ্গেই সংলগ্ন। ‘প্রাকৃত’ জনের সমষ্টিগত জীবন স্পন্দনকে ধারণ এবং বহন করার ঐতিহ্যের মধ্যেই বাংলা সাহিত্যের জন্ম। কারণ বাংলা সাহিত্য
কোনোদিনই সংস্কৃত ভাষা সাহিত্যের অন্ধ অনুকরণ করেনি।
অন্যদিকে ত্রয়োদশ থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাংলাদেশে রাষ্ট্রনৈতিক উত্থান-পতনের জটিলতা ছিল নিরবধি, তা সত্ত্বেও উনিশ শতকের নাগরিক বাঙালি নূতন রেনেসাঁসের বা নবজাগরণে সৃষ্টি করেছিল সমাজ বিপ্লবের রাজপথ বেয়েই; বিংশ শতকের অন্তত একটা স্তরে নাগরিক বাঙালি ইংরেজি শিক্ষার আভিজাত্য মোহকে বর্জন করে বৃহত্তর বাঙালি সমাজের অভিমুখী হয়েছে। সমাজ অভিমুখতা নিঃসংঘাত সমষ্টিমূলকতাই বাঙালি জীবনের স্বতন্ত্র স্বভাবকে ধারণ করেই বাংলা সাহিত্য নিত্য নব বিববর্তনের অধিকার আয়ত্ত করেছে ইতিহাসের চিরন্তন
পথ ধরে। বাংলা সাহিত্যর প্রথমাবধি ভারতীয় সর্বজনীন সমষ্টি ধর্মতার ঐতিহ্যকে বহন করে জাতও বর্ধিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্য সংস্কৃত ও তৎকালীন রাজ ভাষার শ্রেষ্ঠ সম্পদকে করে নিয়েছে আয়ত্ত এবং স্বীকৃত। বাংলা সাহিত্যের এই সর্বাভিমুখী স্বতন্ত্র ঐতিহ্যের অনুসন্ধান, অনুবর্তন এবং অনুসরণই বাংলা সাহিত্য ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ধর্ম হওয়া উচিত।
‘সাহিত্যের ইতিহাস’ বনাম পুথির ইতিহাস প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে সব রচনাই পুথি নির্ভর। ছাপার ব্যবস্থা ছিল না, মূল রচনা পুথির অনুলিখন ছিল সীমিত। অনুলেখকরাও যথেষ্ট শিক্ষিত ছিল না। তাই অনুলিখনগুলিতে ভুল ত্রুটি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, আবহাওয়ার প্রতিকূলতার কারণে প্রাচীন পুথি; তথা মূল লেখকের রচনা প্রায়ই রক্ষা পায়নি। ফলে আমাদের হস্তগত প্রাচীন কাব্যের পুথির লিপিকাল মূল কাব্য রচনার অনেক পরবর্তী। এই ক্ষেত্রে কেবলমাত্র পুথির লিপিকালের ওপরে একান্তভাবে বা প্রধানভাবে নির্ভর করে সাহিত্যিক নির্মিতি’র ইতিহাস নিরূপণ করতে গেলে অনেক সময়ে বিভ্রান্তির হাত এড়ানো কঠিন হয়।
সাহিত্যের ইতিহাস: সাহিত্য এবং ইতিহাস সবশেষে বলা যায় সাহিত্য জীবন সম্ভব। কোনো
বিশেষ কালের বৃহত্তর জীবন অর্থাৎ সে সময়ের অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্মনীতি, সমাজনীতি প্রভৃতি সাহিত্য ভাবনায় ধরা পড়ে এর প্রভাবে অনুরঞ্জিত হয় সাহিত্যের আকৃতি এবং প্রকৃতি। তাই সাহিত্যের বৃহত্তর জীবন ইতিহাসের প্রাসঙ্গিক পরিচয় সন্ধান আবশ্যিক হয়ে ওঠে। কিন্তু এটা দেখতে হবে সাহিত্যের ইতিহাসে বৃহত্তর জীবনের ঐতিহাসিক পরিচয় স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবে বিস্তারলাভ করতে পারে। সাহিত্যের ইতিহাস সন্ধান সাহিত্যের ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে। তাই বলা যায়, সাহিত্যের ইতিহাস। অনুমান কল্পনাবিলাসী সাহিত্য নয়, অসংহত পুরাতত্ত্ব পঞ্জীও নয়, সাহিত্য এবং ইতিহাস।