প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় দেশীয় সাহিত্যের গুরুত্ব আলোচনা করো2024
উত্তর:- অতীতকালের মানুষের ব্যবহৃত সমস্ত দ্রব্য বা রচনা যা তাদের সঠিক ইতিহাস জানতে আমাদের বিশেষ ভাবে সাহায্য করে, সেগুলিকে এককথায় ইতিহাসের উপাদান বা উপকরণ বলা হয়। বর্তমান যুগের ঐতিহাসিকগণ নানা বিচ্ছিন্ন সূত্র থেকে উপাদান সংগ্রহ করে ভারতের ইতিহাস রচনা করেছেন।
■ উপকরণের শ্রেণিবিভাগ: উপকরণগুলিকে মূলত চার ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যথা- (ক) সাহিত্য (খ) লিপি (গ) মুদ্রা এবং (ঘ) স্থাপত্য ও ভাস্কর্য।
Contents
■ সাহিত্যগত উপকরণ:
সাহিত্যগত উপকরণগুলিকে দুইভাগে ভাগ করা যায়।
যথা- (ক) দেশীয় সাহিত্য (খ) বিদেশি সাহিত্য। ◆দেশীয় সাহিত্য: দেশীয় সাহিত্যগুলিকে চার ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-(১)ধর্মীয় সাহিত্য (২) জীবনী সাহিত্য (৩) বিবিধ সাহিত্য এবং (৪) আঞ্চলিক সাহিতা বা ইতিহাস।
(১) ধর্মীয় সাহিত্য:
আর্যদের আগমনের পর থেকে আলেকজান্ডারের আগমন পর্যন্ত সময়ের ইতিহাসের প্রধান উপকরণ বা উপাদান হল ধর্মীয় সাহিত।।
(ক) বৈদিক সাহিত্য:
ধর্মভিত্তিক সাহিত্যের মধ্যে প্রধান হল বৈদিক সাহিত্য। বৈদিক যুগের সাহিত্যগুলি হল চতুর্বেদ, সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আবণ্যক ও উপনিষদ। এই সাহিত্যগুলি থেকে বৈদিক যুগে আর্যদের সমাজ, ধর্ম, অর্থনীতি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়।
(খ) রামায়ণ ও মহাভারত:
রামায়ণ ও মহাভারত ভারতের প্রথম ও সর্বাধিক জনপ্রিয় মহাকাব্য। রামায়ণ থেকে জানা যায় আর্য সভ্যতা দক্ষিণে সিংহল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। মহাভারত থেকে আর্যদের সভ্যতা ও রাজনৈতিক বিস্তারের কথা জানা যায়।
(গ) পুরাণ:
পুরাণ থেকে মধ্যদেশের বিভিন্ন রাজাদের সম্পর্কে জানা যায়। পুরাণ থেকে হস্তিনাপুরের কৌরব রাজগণ, কৌশলের ইক্ষবাকু রাজগণ ও শৈশুনাগ রাজগণ সম্পর্কে মূল্যবান তথ্যাদি পাওয়া যায়। পুরাণ থেকে ভারতের ভৌগোলিক অবস্থা, বহু প্রাচীন শহর, যবন ও হুণ জাতির পরিচয় পাওয়া যায়।
(ঘ)বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মগ্রন্থ:
বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মগ্রন্থ থেকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস জানা যায়। বৌদ্ধ সাহিত্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-দীপবংশ, মহাবংশ, জাতক। দীপ বংশ ও মহাবংশ থেকে মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত ও আশোক সম্পর্কে বহু তথ্য জানা যায়। জৈন ধর্মগ্রন্থ দ্বাদশ অঙ্গ, জৈন ভগবতী সূত্র, জৈন কল্পসূত্র প্রভৃতি থেকে সমকালীন ভারতের সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম ও অর্থনীতি সম্পর্কে জানা যায়।
◆ (২) জীবনী সাহিত্য:
রাজাদের জীবনকাহিনী নিয়ে রচিত বিভিন্ন জীবনী সাহিত্য বা গ্রন্থ থেকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস জানা যায়। হর্ষবর্ধনের জীবনী ভিত্তিক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল বাণভট্টের হর্ষচরিত। চালুক্য বংশীয় রাজা ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের সভাকবি বিলহনের রচিত ‘বিক্রমাদিত্য চরিত্র’ থেকে রাজা ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের কথা জানা যায়। পাল বংশের রাজা রামপাল সম্পর্কে সন্ধ্যাকর নন্দী রচনা করেন ‘রামচরিত’। চালুক্য রাজা কুমার পালকে নিয়ে জৈন আচার্য জয়সিংহ রচনা করেন ‘কুমারপাল চরিত’।
◆ (৩) বিবিধ সাহিত্য:
বিবিধ সাহিত্য বলতে বোঝায় নাটক, কাব্য ইত্যাদি। মহাকবি কালিদাস রচিত রঘুবংশ, ধোয়ী রচিত পবনদূত, কৌটিল্য রচিত অর্থশাস্ত্র, পানিনি রচিত অষ্টাধ্যায়ী, গার্গী রচিত গার্গী সংহিতা প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে প্রাচীন ভারতের রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অপ্রত্যাশিত ভাবে বহু মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়।
◆ (৪) আঞ্চলিক সাহিত্য বা ইতিহাস:
প্রাচীন ভারতের একমাত্র প্রকৃত ইতিহাস গ্রন্থ হল কাশ্মীরের ঐতিহাসিক কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী। রাজতরঙ্গিনী থেকে কাশ্মীরের ইতিহাস জানা যায়। সোমেশ্বর রচিত ‘রাসমালা’ থেকে গুজরাটের ইতিহাস জানা যায়। দক্ষিণ ভারতের ইতিাস জানতে ‘তামিল সঙ্গম সাহিত্য’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
• মূল্যায়ন:
পরিশেষে বলা যায় ইতিহাস রচনায় সাহিত্যিক উপাদানের তথ্যসমূহ গুরুত্বপূর্ণ হলেও এগুলো সতর্কতার সাথে ব্যবহার করতে হবে। তা না হলে ইতিহাসের কাহিনী কিংবদন্তী কাহিনী থেকে পৃথক করা কঠিন হয়ে পড়বে। শুধুমাত্র সাহিত্যিক উপাদান দিয়ে ইতিহাস রচনা করা যায় না। তবে ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতা থাকলেও সাহিত্যগত উপাদানের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। প্রাচীন ভারতে ইতিহাস রচনায় সাহিত্য উপাদানের গুরুত্ব অপরিসীম।