‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্যের স্বাতন্ত্র্যতা আলোচনা করো।
উত্তর: মনসা ও চণ্ডীর ন্যায় আরও অসংখ্য দেবদেবীর পূজা-আরাধনা বাংলার লৌকিক সমাজে চিরকাল প্রচলিত ছিল। এই সমস্ত গ্রাম্য দেবদেবীর সঙ্গে পৌরাণিক
শিব, দুর্গা, চন্ডী প্রভৃতি দেবদেবীর বিশেষ মিল নেই। তুর্কী আক্রমণের ফলে সামাজিক সমন্বয়ের চেষ্টায় লৌকিক দেব-দেবী ধীরে ধীরে পৌরাণিক দেব-মাহাত্ম্যে মণ্ডিত হয়ে অভিজাত সমাজেও সমাদৃত হতে থাকে। শ্রীযুক্ত আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে, ষোড়শ শতাব্দীর পর থেকে বাঙালি হিন্দুর জীবনে নব-সংস্কার প্রবর্তিত হওয়ায় সমাজে লৌকিক দেব-দেবীর প্রাধান্য হ্রাস পায়। তখন কবিগণ পুরাণের দেব-দেবীর মাহাত্ম্যই বর্ণনা করতে আরম্ভ করেন। কিন্তু চৈতন্যোত্তর যুগে সূর্য, গৌরী, শিব, দূর্গা প্রভৃতি স্থানীয় দেবদেবীর মাহাত্ম্যই বর্ণনামূলক মঙ্গলকাহিনী হিসাবে রচিত হয়। তবে মনসা বা চণ্ডীমঙ্গলের ন্যায় কোনো জাতীয় কাব্য এযুগে রচিত হয়নি। শুধুমাত্র রাঢ় অঞ্চলের জাতীয় কাব্যরূপে প্রাচীন বাংলার জীবন কাহিনীর কাঠামোর উপর ধর্মঠাকুরের প্রলেপ দিয়ে ধর্মমঙ্গল কাব্য রচিত হয়।
ধর্মঠাকুর নিয়ে দু-প্রকার কাব্য রচিত। তার একটি রামাই পণ্ডিতের ‘শূন্যপুরাণ’ ও অন্যটি ‘ধর্মমঙ্গল’। শূন্যপুরাণ- এর ৫১টি অধ্যায়ের প্রথম ৫টিতে ধর্মঠাকুরের সৃষ্টিকাহিনী বর্ণিত, মূল গ্রন্থে ধর্মঠাকুরের পূজাপদ্ধতি নিয়ে লিখিত। ধর্মমঙ্গল রাজা হরিশচন্দ্র ও লাউসেনের দুটি কাহিনীর সমন্বয়ে রচিত। লাউসেনের জীবন কাহিনীই ধর্মমঙ্গলের প্রধান বিষয়। ধর্মঠাকুর অনার্য এবং মঙ্গল কাব্যের একমাত্র পুরুষ দেবতা। এর কোনো মূর্তি নেই। দেবতার প্রতীকী হিসাবে কূর্মাকৃতি প্রস্তর খণ্ডই পূজিত হয়ে থাকে। এই দেবতাকে কেন্দ্র করে ধর্ম সম্প্রদায় সৃষ্টি হয়েছে। এই ধর্মসাহিত্যও বিচিত্র এবং অভিনব। এইসময় আরো কিছু অন্যান্য মঙ্গল ব্রত বা সাহিত্যের সৃষ্টি হয়েছিল। চন্ডীমঙ্গল ও মনসামঙ্গল ছাড়াও রায়মঙ্গল, বাসুলিমঙ্গল সত্যপীরের পাঁচালি প্রচলিত ছিল। কিন্তু আধুনিকতার সঙ্গে সঙ্গে এগুলি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়, তবে ধর্মসাহিত্য আজও প্রবহমান। এখনও রাঢ় বঙ্গে ধর্মঠাকুর শিবঠাকুর হিসেবে পূজিত। আজও ধর্মঠাকুর জাগ্রত দেবতা।
মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গলের প্রভাব প্রায় সম্পূর্ণ বাংলাদেশে আছে কিন্তু ধর্ম ঠাকুর আঞ্চলিক দেবতা। ডোম-পুরোহিত বা ডোম ব্রাহ্মণ এখনও পুরুষানুক্রমে ধর্মঠাকুরের পূজা করে চলেছেন। রামাই পণ্ডিতের ছড়া আবৃত্তি করা হয় এবং ধর্মমঙ্গল কাব্যও পড়া হয়। ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মাণ সকলেই, পুত্রলাভের জন্য মেয়েরা, দুরারোগ্য ব্যাধিগ্রস্তরা এই উৎসবে যোগ দেয়।
এই কাব্যে কিছু ঘটনা ও চরিত্র আছে যা ইতিহাসের পাতাতেও পাওয়া যায়। যেমন ধর্মপালের পুত্র দেবপাল, তাঁর বিশিষ্ট মন্ত্রী কর্ণসেনের রাজধানী ময়নাগড় বা ময়না। আর আছে ধর্মপালের পুত্র দেবপালের সেনাপতি লাউসেনের কামরূপ জয় করে কলিঙ্গকে বিবাহ করা। আর ইছাই ঘোষের কথাও আছে।
এছাড়াও ধর্মমঙ্গল অন্যান্য মঙ্গল কাব্য থেকে পৃথক বা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। ধর্মমঙ্গলের পটভূমিকা বাস্তব, সুর অনেকটা ইতিহাস ঘেঁষা। কাব্যটি বাস্তবিক মহাকাব্যের মতো বিপুলকায়। বিরাট আকার ছাড়াও এতে কতকগুলি লক্ষণ মেলে, তাই কাব্যটিকে
Hiroic Poetry বলে উল্লেখ করা যায়। মহাকাব্যের যে লক্ষণগুলি প্রকাশিত সেগুলি হলো- (ক) ধর্মমঙ্গলের আখ্যান বীরত্বের আখ্যান। (খ) ধর্মমঙ্গলের কাহিনী বীররসাত্মক। (গ) মহাকাব্যের নিয়মানুসারেই এই কাব্যের নায়ক লাউসেন উচ্চবংশসম্ভূত এবং বীর। (ঘ) মহাকাব্যের মতোই স্বর্গ-মর্ত্য জুড়ে এ কাব্যের বিস্তৃতি। (ঙ) অসংখ্য চরিত্র এই কাব্যে স্থান পেয়েছে। যদিও মহাকাব্যের মতো সমুন্নতি বা গভীরতা নেই। কিন্তু মহাকাবা বলতে যা বোঝায় তা চণ্ডীমঙ্গল বা মনসামঙ্গল নয়।
ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন, ধর্মমঙ্গল রচনার স্বর্ণযুগে রাঢ়ভূমি নিরবিচ্ছিন্ন যুদ্ধ-বিগ্রহের দ্বারা পরিব্যাপ্ত হয়েছিল। অতএব তখন স্বভাবতই দেশের লোক লাউসেনের যুদ্ধবৃত্তান্ত শুনিবার জন্য আগ্রহান্বিত হইয়াছিল।’ এই কাব্যে আছে বাস্তব জীবনচিত্র, দৃষ্টিভঙ্গী, যুদ্ধ বিগ্রহের জীবন্ত বর্ণনা। আছে রাঢ়দেশের পুরাতন যুগের জীবন আলেখ্য। অন্যান্য মঙ্গলকাব্য থেকে ধর্মমঙ্গল কাব্যের কাহিনী বলিষ্ঠ, এমনকি বীররসাত্মক। তাছাড়া ধর্মমঙ্গল কাব্যের বহু কবি আছেন কিন্তু ওঁদের লেখার পার্থক্য কম। অন্যান্য মঙ্গলকাব্য দেবী প্রাধান্য, ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্যের দেবতা পুরুষ। মঙ্গলকাব্যের নারী দেবীরা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য হিংস্রতা দেখাতেও ছাড়েননি। ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্যে সেরূপ হিংস্রতা ধর্মঠাকুরের মধ্যে পাই না। যদিও দেবী চণ্ডীর সঙ্গে ধর্মের কিছু মিল থাকলেও ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্য অন্যান্য মঙ্গল কাব্য থেকে স্বতন্ত্র।