ধর্মমঙ্গল কাব্যের শ্রেষ্ঠ কবির পরিচয় দাও।
উত্তর: ধর্মঠাকুরের মাহাত্ম্য ও তাঁর পুজো প্রচারের কাহিনী নিয়ে যে কাব্য রচিত হয়েছে, তা মধ্যযুগের সাহিত্যে ধর্মমঙ্গল কাব্যরূপে পরিচিত। অন্যান্য মঙ্গলকাব্যে স্ত্রী দেবতার প্রাধান্য কিন্তু ধর্মমঙ্গলে পুরুষ দেবতার মহিমা কীর্তিত হয়েছে। পুরাণের ধর্মরাজ যম, ‘বৌদ্ধ দেবতা বা সূর্য দেবতা অনার্যদের চিন্তা-কল্পনায় ধর্মঠাকুরে রূপান্তরিত। বাঙলাদেশের এই বিশেষ দেবতার পূজায় কোন বিশেষ অবয়ব নেই। প্রতি গ্রামে বিভিন্ন ধরনের লীলামূর্তিতে বিভিন্ন নামে ইনি পূজিত হন। ধর্মপূজা পুরোহিতদের মধ্যে নিম্ন শ্রেণির মানুষদের বেশি দেখা যায়। ধর্মঠাকুর ফসল উৎপাদনের দেবতা, নারীর বন্ধ্যাত্ব মোচনের দেবতা ও কুষ্ঠ ব্যাধি নিরাময়ের দেবতা।
কবি: যতদূর জানা যায় ধর্মমঙ্গল কাব্যের আদি কবি ময়ূর ভট্ট। এই কবির কাব্যের প্রামাণ্য কোনো পুঁথি পাওয়া যায়নি। শুধুমাত্র কিছু কবির রচনায় তাঁর নাম উল্লেখ পাওয়া যায়।
ময়ূর ভট্টের পর অনেক কবি ধর্মমঙ্গল কাব্য রচনা করেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন রূপরাম চক্রবর্তী। ড. সুকুমার সেনের মতে রূপরাম চক্রবর্তীর কাব্যই সন-তারিখ যুক্ত প্রাচীনতম মঙ্গলকাব্য। তাঁর কাব্যের কয়েকটি পঙ্ক্তিতে রচনাকালের যে ইঙ্গিত আছে তা থেকে মনে হয় কবি ১৬৪৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কাব্যটি রচনা করেছিলেন। যদিও এ বিষয়ে অনেক মতান্তর আছে। কবি প্রদত্ত আত্মপরিচয় থেকে বলা যায় বর্ধমান জেলার ভাইতি-শ্রীরামপুর গ্রামে কবির জন্ম। কবির পিতার নাম শ্রীরাম চক্রবর্তী, মাতার নাম ময়ন্তী। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার অত্যাচারে কবি গৃহত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং নানা জায়গা প্রতে ঘুরতে অবশেষে গোয়ালভূমির রাজা গণেশের আশ্রয় লাভ করেন এবং সেখানে
ধর্মমঙ্গল কাব্য রচনা করেন। গায়কের দল তৈরি করে নিজের কাব্য নিজেই আসরে গান করতেন। রূপরাম সপ্তদশ শতাব্দীর প্রতিভাবান কবি। চরিত্র চিত্রণ ও বর্ণনার গুণে কবি যথেষ্ট কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। সহজভঙ্গীকে প্রাঞ্জল ভাষায় যথোচিত সহানুভূতি ও আন্তরিকতাসহ তিনি মানবজীবনের সুখ-দুঃখকে কাব্যরূপ দিয়েছেন। বাস্তব জীবনের কাহিনী বর্ণনায় রূপরাম কবি কঙ্কনের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছেছেন বললেও অত্যুক্তি হয় না।
ধর্মমঙ্গল কাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি ঘনরাম চক্রবর্তী। গ্রন্থের পরিসমাপ্তিতে কবি যে রচনাকাল নির্দেশ করে গেছেন, তা বিচার করে মঙ্গলকাব্যে বিশেষজ্ঞ ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য ১৭২১ খ্রিস্টাব্দে কবির রচনা সম্পূর্ণ হয় বলে সিদ্ধান্ত করেছেন। বর্ধমান জেলার দামোদর নদের তীরে কৃষ্ণপুর গ্রামে ঘনরামের জন্ম। কবির পিতার নাম গৌরীকান্ত, মাতা সীতাদেবী। ঘনরামের প্রতিপালক ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বর্ধমান রাজ কীর্তিচাঁদ। ঘনরামের কবিরত্ন উপাধিটি সম্ভবত বর্ধমানরাজেরই দেওয়া, তিনি যার সভাকবি ছিলেন। স্বভাবকবিত্বের সঙ্গে পাণ্ডিত্যের যোগে তাঁর কাব্য বিশিষ্ট এক কাব্য হয়ে উঠেছে। তাঁর অধীত সংস্কৃত বিদ্যা তাঁর কবিত্বের অন্তরায় হয়নি। তাঁর ভাষা অত্যন্ত শানিত ও উন্নত রুচির পরিচায়ক। এক্ষেত্রে তাঁকে ভারতচন্দ্রের সঙ্গে তুলনা করা চলে। তাঁর কাছে ভারতচন্দ্রের ঋণ যথেষ্ট। প্রবচনের মতো সংক্ষিপ্ত কথায় গভীর ভাব প্রকাশে ভারতচন্দ্র যে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন ঘনরামই তার সূচনা। ঘনরামের কাব্য বহু পৌরাণিক কাহিনীতে পরিপূর্ণ। গতানুগতিক ধর্মমঙ্গল কাব্যে চরিত্র চিত্রণে অভিনবত্ব আছে। কপূর চরিত্রটিও অভিনবত্ব আছে। কপূর ধবলের চরিত্রটি বিশেষভাবে এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। তার কাব্যে গভীর সমাজচেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। ঘনরামের কাব্য হিসাবে ‘শ্রীধর্মসঙ্গীত’, ‘অনাদিমঙ্গল’ ও ‘মথুরভারতী’ প্রভৃতি নাম উল্লেখযোগ্য। কাব্যটিকে কয়েকটি সর্গে বিভক্ত করে বিভিন্ন পালায় ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে দিয়ে একটা সুসঙ্গতি দান করেছেন। তিনি শাস্ত্র পুরাণাদিতে পণ্ডিত, তাই তাঁর কাব্যে রামায়ণ, ভাগবৎ ও মহাভারতের ছায়াপাত ঘটেছে। ইছাই ঘোষ ও লাউসেনের যুদ্ধ, রাম-রাবণের যুদ্ধের আদর্শ অনুযায়ী বর্ণিত। আবার লাউসেনের বাল্যলীলা কৃষ্ণের বাল্যলীলার অনুসারী। তিনি তাঁর কাব্যে রসের সঞ্চার করে কাব্যে সংস্কারসাধন করে সর্বসাধারণের গ্রহণযোগ্য করেছেন। এই কাব্য প্রথম গ্রাম্যতামুক্ত হয়ে আপনার সম্প্রদায়ের বাইরে শ্রদ্ধার আসন লাভ করে।