ধর্মমঙ্গল কাব্যকে ‘রাড়ের জাতীয় মহাকাব্য’ বলা হয়। যুক্তি দিয়ে আলোচনা করো
উত্তর: ধর্মঠাকুরের মাহাত্ম্য ও তাঁর পুজো প্রচারের কাহিনী নিয়ে যে কাব্য রচিত হয়েছে, তা মধ্যযুগের সাহিত্যে ধর্মমঙ্গল কাব্যরূপে পরিচিত। অন্যান্য মঙ্গলকাব্যে স্ত্রী-দেবতার প্রাধান্য কিন্তু ধর্মমঙ্গলে পুরুষ দেবতার মহিমা কীর্তিত হয়েছে। পুরাণের ধর্মরাজ যম, বৌদ্ধ দেবতা বা সূর্য দেবতা অনার্যদের চিন্তা কল্পনায় ধর্মঠাকুরে রূপান্তরিত। এই বিশেষ দেবতার পূজা বাঙলাদেশের একটি বিশেষ অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ। বস্তুত উত্তর রাঢ়ভুমির বাইরে ধর্মঠাকুর প্রায় অপরিচিত বললেই হয়। এর কোনো বিশেষ অবয়ব নেই। প্রতি গ্রামে বিভিন্ন ধরনের লীলামূর্তিতে বিভিন্ন নামে ইনি পূজিত হন। ধর্মঠাকুর ফসল উৎপাদনের দেবতা, নারীর বন্ধ্যাত্ব মোচনের দেবতা ও কুষ্ঠ ব্যাধি নিরাময়ের দেবতা।
ধর্মমঙ্গল কাব্যের দুটি কাহিনী। একটি পুরাণকেন্দ্রিক রাজা হরিশচন্দ্র ও রানী মদনার কাহিনী কাব্য, অপরটি হল ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বীর লাউসেন ও রঞ্জাবতীর কাহিনী। মনসা ও চন্ডীর কাহিনীর তুলনায় লাউসেনের কাহিনী অনেক বলিষ্ঠ, ঋজু গতি, সংযত ও বাস্তবধর্মী। লাউসেনের কাহিনী সঠিক কবির হাতে পড়লে মধ্যযুগীয় ধর্ম কাব্য নয়, যথার্থ Epic of Growth হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। ইতিহাস বিষয়ক, ভৌগলিক বর্ণনার আবিষ্কারকরা ধর্মমঙ্গল কাব্যকে ‘রাঢ়ের জাতীয় মহাকাব্য’ (The national Epic of Rarha) বলেছেন।।
ধর্মমঙ্গল কাব্যের পটভূমিতে রাঢ় বঙ্গের ইতিহাস, সমাজ, রাষ্ট্র ও জনজীবনের চিত্র প্রতিবিম্বিত। পাঠান, মোগল ও বর্গী প্রভৃতি বিদেশী শক্তির প্রতিরোধ বাঙালীর শৌর্য-বীর্যের পরিচয় এই কাব্যে পাওয়া যায়। বলা যায়, বাংলার ইতিহাসের পদসঞ্চার ঘটেছে এই কাব্যের কাহিনীতে। রাঢ় অঞ্চলের নদী, ভৌগোলিক স্থান, নরনারীর চরিত্র, জীবনযাত্রা প্রণালী ও সামাজিক অনুষ্ঠানের বিবিধ বৈশিষ্ট্যে ধর্মমঙ্গল কাব্যের কাহিনী জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বিশেষ এক অঞ্চলের নানা বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে কাব্যটির শরীর নির্মিত হয়েছে বলে কাব্যটিকে কেউ কেউ আঞ্চলিক বলেছেন। এদিক থেকে বিচার করে সুনীতি চট্টোপাধ্যায় ধর্মমঙ্গলকে রাঢ় দেশের ‘জাতীয় মহাকাব্য’ বলেছেন।
মহাকাব্যের লক্ষণ হল, ব্যাপক ও গভীর কাহিনী, আপাত দুর্বোধ্য শব্দ ও বাক্বীতি, নানা শাখাকাহিনী, পৌরাণিক আখ্যান, বিশেষ সমাজের নয় সর্বযুগের সকল শ্রেণির মানুষের এক কাহিনী। এছাড়া এক মহনীয় আদর্শ, সামাজিক ও পারিবারিক আদর্শ ও আধ্যাত্মিক জীবনের ইঙ্গিত থাকে। থাকে যুদ্ধ বর্ণনা, বীররস প্রধান, নায়ক চরিত্র ধীরোদাও ও আদর্শ স্থানীয় হয়। ধর্মমঙ্গল কাব্যে ঘনরাম তাঁর কাব্যে প্রচলিত কাহিনীকে মহাকাব্যের পর্যায়ে এনেছেন। মনসামঙ্গলে হৃদয় আর্দ্র হয়ে থাকলেও বাঙালিকে এক বীরত্বের জগৎ দেখালেন।
ধর্মমঙ্গলে বীররস বর্তমান। এছাড়া নারীচরিত্রগুলি ব্যক্তিস্বাতন্ত্রে উজ্জ্বল। এই কাবাকে তিনি রামায়ণ ও মহাভারতের আদর্শে লিখেছেন। পৌরাণিক মহাকাব্যের রীতি ও ধর্মমঙ্গলের ঘন পিনদ্ধ কাহিনীকে তিনি মিলিয়ে দিয়েছেন। কাব্যটিতে লাউসেনের বাল্যকালের কাহিনীকে শ্রীমদ্ভাগবতের কৃষ্ণের বালালীলার কাহিনীকে অনুসরণ করে লেখা। লাউসেন ও ইছাই ঘোষের যুদ্ধ আর রাম-রাবণের যুদ্ধ যেন একই। তাঁর কাব্যে তিনি পৌরাণিক মহাকাব্যের আবহ সৃষ্টি করে নাটকীয়তার মধ্যে দিয়ে কাহিনীর গতি এনেছেন। চরিত্র সৃষ্টিতে মহাকাব্যোচিত মর্যাদা দান করেছেন। ধর্মমঙ্গলের শাখাকাহিনীও মহাকাব্যিক আঙ্গিকে লেখা। এই কাব্যের চরিত্রগুলি কোনো অভিশপ্ত চরিত্র। কাব্যের আবেদন, সাহিত্যের, মহাকাব্যের আবেদন। রাঢ় ভূমের কঠিন মাটির মতোই ধর্মমঙ্গলের নারীরাও মহিমায় সমুজ্জ্বল। কাব্যটি সমসাময়িক সমাজ ও জীবনকে অতিক্রম করতে পারেনি বলে সার্থক মহাকাব্য হয়নি। মানবজীবনের সুখ-দুঃখ, আদর্শ বিশ্বাসের প্রতিফলনে জীবনরস প্রকাশ পেয়েছে এই কাব্যে; তাই মানবজীবনের প্রতিফলনে রসোত্তীর্ণ হয়েছে ধর্মমঙ্গল কাব্য।