টীকা লেখো: চর্যার ঐতিহাসিক মূল্য:
উত্তর: বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চর্যাপদ আবিষ্কারের গুরুত্ব অসীম। পূর্বে মনে করা হত কৃত্তিবাসী রামায়ণই বাংলা ভাষার আদিতম নিদর্শন। চর্যাপদ এবং আদিযুগের ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’, ‘প্রাকৃতপৈঙ্গল’, ‘মানসোল্লাস’ ইত্যাদি আবিষ্কারের ফলে ভাষার প্রাচীনত্ব নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। শুধুমাত্র সাহিত্যের সেতুবন্ধন ছাড়াও চর্যাপদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অসীম। বাঙালির ইতিহাস রচনা করার কালে একাদশ শতকের লৌকিক সমাজজীবনের পরিচয় চর্যাপদগুলি থেকে সংগ্রহ করা যায়। বাঙালির সঙ্গীত সাধনার বৈশিষ্ট্যের ঐতিহ্য অনুসন্ধানেও চর্যার রাগ-রাগিনীর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। চর্যাপদে ধর্মভাবনর থাকলেও সাহিত্য-ভাবনা আছে,- তাই ঐতিহাসিক গুরুত্ব অসীম। চর্যাগীতিগুলি রচির হয়েছে কোনো না কোনো রাগের দ্বারা।
বাঙালির সঙ্গীতপ্রিয়তা এবং সঙ্গীত সাধনার ইতিহাস এই পদ থেকে জানতে পারি। এমনকি দশম-একাদশ শতাব্দীর সমাজ জীবন, লৌকিক জীবনকেও জানতে পারি। বাংলা ভাষার বিবর্তনের রূপটাও আমরা দেখতে পাই প্রকাশিত এই পদগুলিতে। চর্যাপদ আবিষ্কারের পর তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস রচনা ও শাস্ত্রগ্রন্থ সম্পাদনার ব্যাপারে গবেষকদের মধ্যে তৎপরতা দেখা যায়। গ্রন্থটি আবিষ্কারের পরে বাংলা ভাষা সাহিত্যের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ বিষয়ক পূর্বের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে ফাটল ধরে। শুধু বাংলা নয়, হিন্দি, মৈথিলি, ওড়িয়াসহ অন্যান্য আর্যভাষা ও সাহিত্যের ঐতিহাসিকদের মধ্যেও তৎপরতা দেখা যায়। চর্যাগীতিকাতে সর্বপ্রথম পয়ার ত্রিপদীর আদিসুর শোনা গিয়েছে। সংস্কৃত গীতগোবিন্দের গীতগুলিতেও এর প্রভাব পড়েছে। চর্যার পাদাকুলক ছন্দ থেকেই পরবর্তীকালে পয়ার ছন্দের উদ্ভব হয়। ঐতিহাসিক গুরুত্ব হিসেবে বলতে হয়, চর্যাকে তৎকালীন সমাজের একটি সামাজিক দলিল বলতে পারি। যদিও এই পদগুলি বৌদ্ধধর্ম ও দর্শনের তত্ত্ব পরিচয় বহন করে, সাহিত্যিক এবং কাব্যিক তাৎপর্যও এর কম নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাষাতত্ত্বের দিকটি। শিবসঙ্গীত, শাক্তপদাবলী, বৈষ্ণব মরমীয়া সাধনা, আউল-বাউল সাধনার গানেও চর্যাপদের প্রভাব যথেষ্ট।
প্রশ্ন: ৫। চর্যার সাধনতত্ত্ব বিষয়ে আলোচনা করো।
উত্তর: বৌদ্ধসাধকদের ধর্মসাধনার যে প্রক্রিয়া, গোপন ভাষার মাধ্যমে তার
বিষবয়স্তুকে প্রকাশ করেছেন চর্যার পদকর্তারা। এই বৌদ্ধসাধকদের তিব্বতী ভাষায় বলে সিদ্ধাচার্য। তৎকালীন আচার সর্বস্ব ব্রাহ্মণ্য ধর্ম আচরণের প্রতি বিদ্রূপ দেখিয়েছেন আবার কোথাও তান্ত্রিক দেহবাদের প্রতি আস্থাও দেখিয়েছেন চর্যাকাররা। সহজযানপন্থীরা ধর্মসাধনায় সহজমার্গের পথিক। তান্ত্রিক হঠযোগ বা দেহসাধনার দ্বারাই সিদ্ধাচার্যরা জন্মমৃত্যু, সুখ-দুঃখ- সবকিছুর ঊর্ধ্বে এক নির্বিকল্প আনন্দ উপভোগ করতে চান। দেহসাধন, ত্রিনাড়ীতত্ত্ব ও মহাসুখ-এই-ই চর্যার বিষয়বস্তু। তাঁরা দেহসাধনার দ্বারা পরমার্থ লাভ করতে চান। ‘সোজা পথ ছেড়ে বাঁকা পথে যেও না- নিকটেই বোধি আছে দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।’
সিদ্ধাচার্যরা ইহকাল-পরকাল প্রভৃতি অস্তিত্ববোধের কারণ হিসেবে দেহের মধ্যে ইড়া ও পিঙ্গলা নামে দুটো নাড়ীকে দেখে। মানুষের শরীরে অজস্র শিরা-উপশিরার মধ্যে তিনটি প্রধান-ইড়া, পিঙ্গলা ও সুযুন্না। ইড়া ও পিঙ্গলা সর্বদা সুষুম্নার গতিকে নিচের দিকে টানে। সাধক খুব সন্তর্পণে ইড়া-পিঙ্গলার প্রভাব থেকে সুষুম্নাকে মুক্ত রেখে তাকে মাথার শীর্ষে নিয়ে যান। তখন মনে অনির্বচনীয় আনন্দ লাভ হয়। দেহসাধনার দ্বারা
সুষুন্না নাড়ীর প্রবাহকে সাধক ব্রথারক্ত বা সহস্রার পথে চালিত করে এক অনির্বচনীয় মহাসুখ অনুভব করেন। মহাসুখ অনির্বচনীয়, বর্ণনাতীত এক সুক্ষ্ম আনন্দময় অবস্থা। আনন্দ চার প্রকার- আনন্দ, পরমানন্দ, বিরমানন্দ ও সহজানন্দ। সমরস হলে সহজানন্দ নয়। মহাসুখ লাভে সমস্ত ইন্দ্রিয় অচেতন হয়ে পড়ে এবং জন্ম-মৃত্যু, সুখ-দুঃখ, আপন-পর ভেদাভেদ জ্ঞান চলে যায়।