চৈতন্যজীবনী কাব্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও
উত্তর: মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে শ্রীচৈতন্যদেবকে নিয়ে এক নতুন সাহিত্যের ধারা প্রবাহিত হয়েছে। জীবনীমূলক রচনার উদ্ভব প্রাচীনকাল থেকেই। অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিত, সৌন্দরনন্দ ও শারিপুত্র প্রকরণ, বাণভট্টের হর্ষচরিত, কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী’ বিশিষ্ট উদাহরণ। তৎকালীন কবিরা বেশিরভাগ রাজারাজড়াদের জীবনী মহিমা রচনা করতেন, সাধারণ মানুষের কথা ভাবেননি। প্রথমে সংস্কৃতভাষায় চৈতন্যজীবনী গ্রন্থ রচিত হয়। তার মধ্যে মুরারী গুপ্তের শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যচরিতামৃত, কবি কর্মপুরের মহাকাব্য, চৈতন্য চরিতামৃত ও নাটক চৈতন্য চন্দ্রোদয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও আছেন বৃন্দাবন দাস, জয়ানন্দ, লোচন দাস ও কৃষ্ণদাস কবিরাজ প্রমুখ।
মধ্যযুগের বাংলা ইতিহাসে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক শ্রীচৈতন্য। শ্রীচৈতন্যের দিব্যভাব ও অলৌকিক জীবন সাহিত্যে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। তার সুমহান জীবনধারা, চরিত্রের দৃঢ়তা, মহৎ প্রেমধর্মের জন্য তিনি অবতাররূপে পূজিত হয়েছেন। শ্রীচৈতন্যকে ‘রাধা ভাব দ্যুতি সুবলিত কৃষ্ণ স্বরূপম্’ রূপে দেখেছেন। যেন মর্তোর মানবের মধ্যে বিশ্বরূপ দর্শন করতে পারলাম।
শ্রীচৈতন্যের জীবদ্দশাতেই তাঁর দিব্যজীবনকে কেন্দ্র করে অন্যতম সহচর মুরারী গুপ্ত ও তাঁর পার্যদ স্বরূপ দামোদর সংক্ষিপ্ত কড়চার সঙ্গে সংস্কৃতে চৈতন্য জীবনী কথা রচনা করেন। মহাপ্রভুর তিরোধানের পর পরমানন্দ ও প্রবোধানন্দ সরস্বতী সংস্কৃতে কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। বাংলায় বৃন্দাবন দাস, লোচন দাস, কৃষ্ণদাস কবিরাজ চৈতন্য জীবনীকাব্য রচনা করেন।
১৫৩৩-১৫৪২ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃতে মুরারী গুপ্ত রচনা করেন ‘শ্রীশ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য- চরিতামৃত’ যা মুরারী গুপ্তের কড়চা নামে পরিচিত। শ্রী গৌরাঙ্গের সহপাঠী ছিলেন তিনি। আটাত্তর সর্গে বিভক্ত গ্রন্থে কবি মহাপ্রভুকে কলিযুগের অবতার মনে করেছেন। চৈতন্যজীবনের মূল তথ্যকে অবিকৃত রেখে মহাপ্রভুর বরাহভাব, দেবগণ কর্তৃক শচীর বন্দনা ও হির নামক কুষ্ঠরোগীর ব্যাধি নিরাময়-এর অলৌকিকতা বর্ণনা করেছেন গ্রন্থে। মহাপ্রভুর শৈশব, দূরন্তপনা, মাতার প্রহার, শিক্ষা, বিবাহ, দেশভ্রমণ, নীলাচল লীলা বর্ণনা করেছেন।
এরপর বাংলা ভাষায় প্রথম চৈতন্যজীবনী কাব্য রচনা করেন বৃন্দাবন দাস। নবদ্বীপের শ্রীবাসের ভ্রাতুস্পুত্রী নারায়ণী দেবীর ছেলে বৃন্দাবন দাস। পিতার নাম অজ্ঞাত। কবির নিবাস ছিল বর্ধমান জেলার দেনুড় গ্রামে। কবি মহাপ্রভুকে কৃষ্ণের অবতার মনে করেছেন। ফলে কৃষ্ণ ও চৈতন্য অভিন্নাত্মক। কৃষ্ণলীলার অনুকরণে কবি চৈতন্যজীবনকে ফুটিয়ে তুলেছেন। কেউ কেউ বলেন, গ্রন্থটির নাম ‘চৈতন্যমঙ্গল’। কৃষ্ণদাস কবিরাজের গ্রন্থে এই নামের উল্লেখ আছে। ভাগবতকে অনুসরণ করে লেখা বলে বৃন্দাবন গোস্বামী
এর নাম দেন চৈতন্যভাগবত। লোচন দাসের লেখা ‘চৈতন্যমঙ্গল’ থাকায় মায়ের নির্দেশে তাঁর গ্রন্থের নাম পরিবর্তন করেন।
চৈতন্যভাগবত আদি-মধ্য-অন্ত্য এই তিন খণ্ডে বিভক্ত। আদি খণ্ডে চৈতন্যের জন্ম, বাল্যলীলা, বিবাহ, বিদ্যাশিক্ষা, অধ্যাপনা, পিতৃপিণ্ড দানের জন্য গয়া গমন, ঈশ্বরপুরীর কাছে দীক্ষা, স্বদেশে ফিরে আসা পর্যন্ত বিধৃত হয়েছে। মধ্যখণ্ডে নবদ্বীপে হরিনাম সংকীর্তন-এ বিভোর লীলাবৈচিত্র্য, অধ্যাপনা ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ পর্যন্ত বিবৃত হয়েছে। কাজীর বিরোধিতা, কাজী দলন ও উদ্ধার এই খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। অন্ত্যখণ্ডে নীলাচল বাসের কাহিনী স্থান পেয়েছে। এই গ্রন্থ রচনার জন্য তাকে ‘ব্যাস’রূপে মানা হয়। শ্রীচৈতন্য মানবিকতা ও আধ্যাত্মিকতার এক যুগ্ম বিগ্রহ। শুধু অবতারত্ব নয়, এখানে কবি ভক্তিরসের সঙ্গে জীবনরসের আশ্চর্য সমন্বয়সাধন করেছেন। শৈশবোচিত দুরন্তপনা ও কপটু কলহপ্রিয় কৈশোরকালের যে বর্ণনা করেছেন কবি তাতে মনে হয় জীবনরসরসিক কবি মহাপ্রভুকে রাগ-অভিমানপূর্ণ এক রক্তমাংসের সজীব মানুষ করে তুলেছেন।
বৃন্দাবন দাস চৈতন্যভাগবতে সমাজচেতনার পরিচয় দিয়েছেন। সামাজিক, রাষ্ট্রনৈতিক, অর্থনৈতিক, লৌকিক ইতিহাসের আলেখ্য তাঁর গ্রন্থটি। বিদ্যাচর্চা, অন্ধ সংস্কার, ধর্মাচার, আমোদ-প্রমোদ, বৈষ্ণব নিন্দা পরিচায়ক গ্রন্থটি। পাঠান শাসনের ফলে হিন্দু সমাজ ও ধর্ম অন্ধকারে ডুবে গিয়েছে। শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের পর হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের অবনমন ঘটে। চৈতন্য আবির্ভাবে যে নবজাগরণ আসে তা নষ্ট করতে মুসলিমরা বদ্ধপরিকর হয়েছিল। শ্রীচৈতন্যের কাজী দলনের ব্যাপারটাও আছে। তিনি কাজীর বাগানবাড়ি ধ্বংস, কাজীর ঘরে আগুন দিতেও বলেছিলেন। বাধ্য হয়ে কাজী কীর্তনের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। ‘চৈতন্যভাগবত’ গ্রন্থটিকে ঐতিহাসিকতা ও মানবতার ঊর্ধ্বে তুলে কবি বৃন্দাবন দাস ভাগবতী মাহাত্ম্যে উত্তীর্ণ করেছেন। সর্বোপরি ষোড়শ শতাব্দীর বৈষ্ণব সমাজের তথ্যের জন্য কাব্যটির মূল্য অনেক।
এছাড়া লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল, কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যমঙ্গল উল্লেখযোগ্য। তবে ‘চৈতন্যভাগবত’ উল্লেখযোগ্যভাবে সবার অন্তর ছুঁয়ে গিয়েছে।