চর্যাপদের আবিষ্কার সম্পর্কে আলোচনা করে বাংলা সাহিত্যের আদিযুগের একমাত্র নিদর্শন চর্যাপদে ব্যবহৃত ভাষা সম্পর্কে আলোচনা করো 2024
চর্যাপদের আবিষ্কার সম্পর্কে আলোচনা করে বাংলা সাহিত্যের আদিযুগের একমাত্র নিদর্শন চর্যাপদে ব্যবহৃত ভাষা সম্পর্কে আলোচনা করো 2024
উত্তর : আবিষ্কার: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হল ‘চর্যাপদ’। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যখন প্রাচীন পুঁথিপত্রাদির সন্ধান করছিলেন তখন তাঁর মনে হয়েছিল প্রাচীন যুগে বৌদ্ধ তান্ত্রিক সহজিয়া সিদ্ধাচার্যগণ বাংলা ভাষায় কিছু লিখে থাকতে পারেন। এই উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবারে গিয়ে অনেক পুঁথির মধ্যে থেকে বাংলা ভাষায় লেখা ‘চর্যাচর্য বিনিশ্চয়ের’ পুঁথি আবিষ্কার করেন।
তিনি বিস্মিত হয়ে পড়ে দেখলেন এর ভাষা অতি প্রাচীন বাংলা। তিনি দেখলেন বৌদ্ধ তান্ত্রিক সহজিয়া ত গুরুদের রহস্যময় ভাষায় লেখা এর গূঢ় অর্থ পাঠোদ্ধার করা অতি সহজ ব্যাপার নয়। এই পুঁথির সঙ্গে একটি সংস্কৃত টীকা দেওয়া ছিল বলে শাস্ত্রী মহাশয় এই পদগুলির অর্থ কিছুটা বুঝতে পারেন। এই টীকাকার হলেন বিখ্যাত মুনিদত্ত। এই পুঁথিগুলি নকল করে এনে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সম্পাদনায় ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশ হয় “হাজার বছরের পুরানো বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোঁহা” এই শিরোনামে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’, ‘শরহ ও কাহ্ন পাদের দোহাকোষ’ এবং ‘ডাকার্নব’।
পরে ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণায় জানা যায়’চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ই একমাত্র প্রাচীন বাংলা ভাষায় রচিত, অন্যগুলির ভাষা শৌরসেনী অপভ্রংশ। ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ এর শেষের কয়েকটি পাতা নষ্ট হয়ে গেছিল বলে গ্রন্থটিতে ৪৬ টি পূর্ণপদ এবং একটি অর্ধপদ সংকলিত হয়েছিল। পরে ড. প্রবোধ চন্দ্র বাগচী মূল পুঁথির একটি তিব্বতী অনুবাদ আবিষ্কার করেন, সেখানে শেষের সাড়ে তিনটি পদ পাওয়া যায়। তিব্বতী অনুবাদকের নাম কীর্তিচন্দ্র ।
সুতরাং চর্যাপদে সর্বমোট ৫০টি পদ। চর্যাপদের ৫০টি পদ রচনা করেছেন ২৩ জন সিদ্ধাচার্য। এরা হলেন লুইপাদ, ভুসুকুপাদ, কাহ্নপাদ, সরহপাদ, শান্তিপাদ, শবরপাদ কুকুরীপাদ, লাড়ী ডোম্বীপাদ, ডোম্বীপাদ, ধামপাদ, বীণাবাদ খুদ, বিরুপাপাদ কংকণপাদ, জয়নন্দিপাদ, ট্রেন্ডনপাদ, কম্বলাম্বরপাদ, মহীধরপাদ, আর্যদেওপাদ, তাঁয়কলান, ভদ্রপাদ। সবচেয়ে বেশি পদ কাহ্নপাদের ১৩টি। এছাড়া লুইপাদ ২টি, ভুসুকুপাদ – ৮টি, সরহপাদ- ৪টি, শান্তিপাদ ২টি, শবরপাদ ২টি, কুকুরীপাদ লাড়ী ডোম্বীপাদ ও অন্য সকলে ১টি করে।
চর্যার ভাষাঃ চর্যাগীতিতে বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের অধ্যাত্মতত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব বিষয়ক গান আছে। পদকর্তারা সকলের বোধগম্য করে লেখেন নি। রূপক, উপমা, উৎপ্রেক্ষার সাহায্যে বক্তব্যগুলিকে এক আলো-আঁধারি অবস্থায় প্রকাশ করেছেন। এই পদগুলির বাহ্য অর্থ ও গুচার্থ ভিন্ন। এরূপ ভাষা বৌদ্ধ সাধক ছাড়া বুঝতে পারে না। চর্যার টীকাকার মুনি দন্ড এইরূপ ভাষাকে সন্ধ্যাভাষা বা সন্ধ্যারীতি বলেছেন।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় বলেছেন, ‘সন্ধ্যাভাষার মানে আলো-আঁধারি ভাষা, কতক আলো কতক অন্ধকার। খানিক বুঝা যায় খানিক বুঝা যায় না।’ অনেকে লিপিকর প্রমাদ ভেবেছেন। সম-ধা ধাতু থেকে এই সন্ধ্যা শব্দের উৎপত্তি। ব্যুৎপত্তি অনুযায়ী বলা যায়, সন্ধ্যা ভাষা বা বচনের অর্থ যে ভাষা সম্পূর্ণরূপে গূঢ় থাকে অর্থাৎ বলা যায় সাংকেতিক ভাষা। ধর্মচর্যার গোপনীয়তার প্রয়োজনে সাধকরা সাংকেতিক ভাষায় নিজ গোষ্ঠীর মধ্যে কথা, তত্ত্বতালাশ করতেন। চর্যার পদকর্তারা গুহ্য সাধনের তত্ত্ব বাইরে প্রকাশ না করার বিষয়ে সতর্ক থাকতেন। গুহ্যত্ব রক্ষার জন্য সন্ধ্যা ভাষা প্রয়োগ করতেন। বিভিন্ন তন্ত্র বিষয়ক গ্রন্থেই এরূপ আলো-আঁধারি ভাষা ব্যবহার করা হয় যাতে কেউ সেটা না জানতে পারে। চর্যাকাররা তন্ত্রনির্ভর ছিলেন বলেই এরূপ সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করেছেন। তাই এর নাম সন্ধ্যাভাষা। যেমন-
‘উঁচা উচা পাবত তর্হি বসই সবরী বালী
মোরঙ্গি পীচ্ছ, পরহিন সবরী পিবত গুঞ্জরী মালী।’