কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত বর্ণনা করো।Describe Krishnadas Kaviraj’s Chaitanyacharitamrita.
উত্তর: ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ বাংলায় লেখা কৃষ্ণদাস কবিরাজের তৃতীয় ও সর্বশেষ গ্রন্থ। চৈতন্যচরিত সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি তিনি। কৃষ্ণদাস কবিরা মনীষাসম্পন্ন প্রতিভাশালী কবিব্যক্তিত্ব। বৃন্দাবনের গোস্বামীদের ব্যাখ্যাত তত্ত্ব ও দার্শনিক সিদ্ধান্তকে তিনি ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ রচনায় প্রয়োগ করেছেন। অধ্যাপক ড. অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘চৈতন্যচরিতামৃত ১৫৯২ খ্রীস্টাব্দের পরে রচিত হইতে আরম্ভা হয়, তাহার পূর্বে কদাপি নয়’ তখন কবি ‘অতিবৃদ্ধ জরাতুর’। কবি বর্ধমান জেলার ঝামটপুর গ্রামে বৈদ্য পরিবারে ১৫২৭ খ্রীস্টাব্দে জন্ম নেন। পিতার নাম ভগীরথ, মাতা সুনন্দা দেবী। নিতানন্দ তার গুরু ছিলেন। নিত্যানন্দের স্বপ্নাদেশ পেয়ে বৃন্দাবনে যান কিন্তু গ্রন্থ লেখেন বয়োঃবৃদ্ধ কালে। তিনি সংস্কৃতে দুটি গ্রন্থ রচনা করেন। ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে বার্ধক্যজনিত কোন প্রভাব পড়েনি।
তিনি জানতেন তাঁর এতটা বয়সে শ্রীচৈতন্যের অনন্ত, অপার, লীলা কীর্তন রচনা করা সম্ভব নয়। তাছাড়া তিনি নিজের চোখে চৈতন্যের লীলা দেখতে পান নি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন চৈতন্যজীবন মাহাত্ম্যে কিছুটা ক্লান্তি জাগছে। তিনি গ্রন্থ রচনা করেছেন যা তাঁর পূর্বজরা বিস্তারিত জানতো না। তাই তিনি লীলা রচনায় জোর দিয়েছিলেন।
চৈতন্য চরিতামৃত আদি-মধ্য-অন্ত্য এই তিন লীলাপর্বে লিখিত। প্রত্যেক লীলা কয়েকটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত। নতুন বিষয়বস্তুর সঙ্গে বৈষ্ণবীয় তত্ত্বকে অনেকাংশে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। আদিলীলায় বৈষ্ণবীয় দর্শন, চৈতন্যাবতারের প্রয়োজনীয়তা, অদ্বৈত নিত্যানন্দের সঙ্গে মহাপ্রভুর পরিচয়, শ্রীচৈতন্যের বাল্যলীলা, কৈশোর ও সন্ন্যাস বর্ণিত হয়েছে। বৃন্দাবন দাসকে অনুসরণ করে আদিলীলা রচনা করেছেন। বৃন্দাবনের পণ্ডিত, সাধক ভক্তদের সৃষ্ট কঠিন বৈষ্ণবীয় তত্ত্বকে কবি কৃষ্ণদাস প্রাঞ্জল সরস কাব্যভাষায় ব্যাখ্যা করলেন। প্রাবন্ধিকের মতো যুক্তি, উদাহরণ, প্রমাণ দিয়ে বৈষ্ণব দর্শনকে সাধারণ বাঙালীর কাছে সহজ করে দিলেন। জোর দিয়ে বললেন ‘কৃষ্ণ ভজনে নাই জাতি-কুলাদি-বিচার।’
মধ্যলীলায় শ্রীচৈতন্যের সন্ন্যাসের পর নীলাচলে অবস্থানকালীন ছয় বৎসরের জীবনকাহিনী বর্ণিত হয়েছে। রাঢ়দেশ ভ্রমণ, নীলাচলে গমন, সার্বভৌমকে স্বমতে আনা, দাক্ষিণাত্যে নানা তীর্থ পর্যটন, রায় রামানন্দের সঙ্গে সাধ্যসাধন তত্ত্বের আলোচনা, বৃন্দাবন যাত্রা, প্রয়াগে রূপ গোস্বামী ও বারাণসীতে সনাতন গোস্বামীকে ধর্মশিক্ষা দান, রূপ গোস্বামীকে বৃন্দাবনে পাঠানো ইত্যাদি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।
অন্ত্যলীলায় শ্রীচৈতন্যের শেষ আঠারো বছরের জীবনকাহিনী বিস্তৃত হয়েছে। শ্রীচৈতন্যের শেষ জীবন নিয়ে কোন চৈতন্যজীবনীকার বিস্তৃত পরিচয় দেননি। কবিরাজ মহাশয় মহাপ্রভুর কৃষ্ণপ্রেমে দিব্যোন্মাদ ও বাহ্যজ্ঞানহীন বিভোর অবস্থার স্বরূপ ব্যাখ্যা করেছেন।
পরিমিত বাক্যবিন্যাস, ভক্তি তন্ময়তা, অলঙ্কার ও পয়ারের শোষণশক্তিকে নির্ভর করে চৈতন্যচরিতামৃত দর্শন ও কাব্যের মুক্তবেণী রচনা করেছেন। কাম ও প্রেমের পার্থক্য বিচারে-“আত্মেন্দ্রিয় প্রীতিইচ্ছা, তারে বলি কাম। কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতিইচ্ছা ধরে প্রেম নাম।।”
মহাসুখ সাগর কৃষ্ণপ্রেমের স্বরূপ বলতে গিয়ে বর্ণনা করেছেন-
“এই প্রেম আস্বাদন তপ্ত ইক্ষু চর্বণ জিভ বলে না যায় ত্যজন।।”
কবিরাজ মহাশয় চৈতন্যের জীবনী লিখতে চাননি। মহাপ্রভুর জীবনীকে অবলম্বন করে ভক্তি ও আন্তরিকতার সহিত শ্রীচৈতন্যের জীবনের পবিত্র আদর্শ প্রচার করতে চেয়েছেন। তত্ত্ব বিশ্লেষণ নয়, কবিত্ব শক্তিরও পরিচয় দিয়েছেন তিনি। শ্রীচৈতন্যের তিরোধানের আশি বছর পর গ্রন্থটি রচিত। এতদিনে বিভিন্ন চৈতন্য জীবনীর ভক্তির যে দার্শনিক তাৎপর্য বিশ্লেষণে মহাপ্রভুর অধ্যাত্ম সত্ত্বার এক ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিল, কৃষ্ণদাস নতুন ভাবব্যঞ্জনার আধারে সেই সব তথ্যকে রস ও রহস্যালোকে রূপান্তরসাধন করেন। বৃন্দাবনে যখন ষড় গোস্বামীরা চৈতন্য প্রবর্তিত ধর্মতত্ত্ব সাধন পদ্ধতিকে সংস্কৃত ভাষায় লিখছেন তখন কৃষ্ণদাস কবিরাজ বাংলার ছেলের আচরিত ধর্মতত্ত্বের স্বরূপ ও তার মহিমাকে বাংলা ভাষায় প্রকাশ করলেন। তাঁর সরস বর্ণনা তাঁকে শ্রেষ্ঠ শিল্পী করেছে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘চৈতন্য চরিতামৃত এক অসাধারণ মহৎ কাব্য’ বলে অভিহিত।