কৃত্তিবাসী রামায়ণের রচয়িতার আবির্ভাবকাল ও সম্পূর্ণ পরিচয় দাও। এর সাহিত্যিক মূল্য এবং বাঙালীর জীবনে এর গুরুত্ব আলোচনা করো 2024
উত্তর: পৃথিবীর চারটি মহাকাব্যের একটি হল রামায়ণ। বাংলাভাষায় প্রথম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ রামায়ণ রচয়িতা কবি কৃত্তিবাস। কবির রামায়ণ বহু শতাব্দী পেরিয়েও বাঙালীর জাতীয় জীবনের মহাকাব্য হয়ে আছে।
১৮০২ খ্রীষ্টাব্দে শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন থেকে কৃত্তিবাসের রামায়ণ ‘কীর্তিবাস রামায়ণ’ বলে প্রকাশিত হয়। বাল্মীকি রামায়ণকে বাঙালী জীবনের উপযোগী করে পরিবেশন করেন কৃত্তিবাস। গ্রামগঞ্জের মানুষের মনের মতো করে গানের আকারে রচনা করেন। কবি কৃত্তিবাস তাঁর রামায়ণকে ‘লাচাড়ি’ ছন্দের পুরাণ বলেছেন। মূল রামায়ণ গানের মতো করে গীত হত বলে তার নাম ছিল পাঁচালী-‘শ্রীরাম পাচালী’।
কবি সংস্কৃত রামায়ণকে অনুধ্যান করে বাঙালী জীবনের উপযোগী করে পরিবেশন করেছেন। কবি অনেক ক্ষেত্রে মূল সংস্কৃত শ্লোককে অনুসরণ করে অনুবাদ করেছেন। কবির জীবন পরিচয় প্রসঙ্গে সঠিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু বলা যায়, তিনি চৈতন্য-পূর্বযুগের কবি। রাজনারায়ণ বসু তাঁর ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বক্তৃতা’ (১৮৭৮)-তে উল্লেখ করেছেন, কৃত্তিবাস ফুলে গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৪৬০ সালে রামায়ণ রচনা করেন। চৈতন্যের আবির্ভাবের পূর্বেই কৃত্তিবাস ‘শ্রীরাম পাঁচালি’ রচনা করেন। ১৩৪০ বঙ্গাব্দের ১৮ই আষাঢ় সাহিত্য পরিষদের মাসিক অধিবেশনে যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি ‘কৃত্তিবাসের জন্মশক’ নামে প্রবন্ধে বলেছেন-
‘আদিত্যবার শ্রীপঞ্চমী, পূর্ণ মাঘ মাস।
তথি মধ্যে জন্ম লইলাম কৃত্তিবাস।।’
ঐতিহাসিকেরা গৌড়েশ্বরের সন্ধান ঐ সময়ে পাননি। তবে ১৩২০ শকে রবিবারে শ্রীপঞ্চমী ও হিন্দু গৌড়েশ্বর দুই-ই পাওয়া যাচ্ছে। কৃত্তিবাস এগারো বছর বয়সে বিদ্যাশিক্ষার জন্য উত্তর দেশে গিয়েছিলেন। নয়-দশ বছর রাজভটে থাকেন, ফলত তখন তাঁর বয়স ২০-২১ বৎসর হওয়া সম্ভব। অতএব কৃত্তিবাসের জন্ম ১৩২০ শকে। আধুনিক গবেষকরা ১৪৪৩ খ্রীষ্টাব্দকে কৃত্তিবাসের জন্ম বৎসর বলেছেন।
১৮০২ খ্রিস্টাব্দে মিশনারীরা প্রকাশ করেন কৃত্তিবাসী রামায়ণ। বাঙালী জনমানসে রামের প্রতি কৌতূহলের কথা ভেবে গানের মাধ্যমে গ্রামেগঞ্জে শহরে তা প্রচার করার জন্য গানের আকারে কৃত্তিবাস এই রামায়ণ রচনা করেন। ছন্দ, নাচ, গান অভিনয়ের মাধ্যমে পরিবেশন করা হয় বলে কবি তাঁর কাব্যকে ‘লাচাড়ি’ ছন্দের পুরাণ বলেছেন। তবে গায়কেরা নিজ এলাকার মানুষের মনের চাহিদা অনুসারে কাহিনী, ঘটনা, ভাষার পরিবর্তন করেছেন। ঘরে ঘরে সাধারণ আপামর মেহনতী মানুষের কাছে যেমন কৃত্তিবাস গ্রহণীয় তেমনি শিক্ষিত পরিবারেও তিনি গ্রহণীয়।
কৃত্তিবাসের রামায়ণ বাঙালীর জীবনকে পারিবারিক আদর্শের প্রতি দৃঢ়সংবদ্ধ করে রেখেছে। তিনি তাঁর রামায়ণে পুরাণের কাঠামোয় বাঙালীর জীবনরস ও গৃহের আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আধুনিক যুগেও বাঙালী জীবনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আদর্শের ভোল বদল হয়েছে আবার জীবনের মূল্যবোধের পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু কৃত্তিবাস বাঙালী জীবনে কালজয়ী অমরত্ব লাভ করেছেন।
অনেকে এই গ্রন্থকে পাঁচালি শ্রেণীর অর্ন্তভুক্ত করেছেন। কৃত্তিবাস বাল্মীকিকে আক্ষরিক অনুবাদ না করলেও মূল রামায়ণ-কে অনুকরণ করেছেন। কৃত্তিবাসী রামায়ণে মহাকাব্যিক বিশালতা নেই। তবে বহুদিন ধরে হস্তক্ষেপ ও পরিবর্তনের ফলে মূল পুঁথির স্বরূপটি আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছে। বাল্মীকির মতো কৃত্তিবাস নরচন্দ্রমা রামের কাহিনী বিবৃত করেননি।
করণরসের বর্ণনায় কৃত্তিবাস অসাধারণ প্রতিভাধর কবি। এই করুণরস রামের বনবাস থেকে সীতার পাতাল প্রবেশ পর্যন্ত পাঠককে অশ্রুসিক্ত করেছে। শুধু তাই নয় রাবণের হাসির বর্ণনা দিতে গিয়ে হাস্যরস সৃষ্টি করেছেন। কৃত্তিবাসের চরিত্রগুলিতে মহাকাব্যের ওজস্বিতা নেই কিন্তু বাঙালী জীবনের আদর্শ কথা প্রকাশ পেয়েছে। কৃত্তিবাসের রাম ক্ষত্রিয় পুরুষ নয় প্রেমের দেবতা। রাম সীতার দুঃখে আকুল। লক্ষ্মণ উদ্ধত, সীতা বাঙালী বধু, রাবণ উচ্ছৃঙ্খল হয়েও রামের প্রতি ভক্তও বটে। কবি শ্রী মধুসুদন যথার্থই বলেছেন কৃত্তিবাস বাংলার অলংকার। যতদিন বাঙালী বেঁচে থাকবে ততদিন বেঁচে থাকবে কৃত্তিবাসের রামায়ণ, ততদিন বেঁচে থাকবেন কবি কৃত্তিবাস।