কৃত্তিবাসী রামায়ণের মৌলিকতা আলোচনা করো 2024
উত্তর: কবি কৃত্তিবাস বাঙলার একজন আদি কবি। কবি কৃত্তিবাস পঞ্চদশ শতাব্দীতে বাংলা ভাষায় রামায়ণ অনুবাদ করেন। সংস্কৃত কাব্যে বাল্মীকির যেরূপ স্থান বাংলা কাব্যেও কৃত্তিবাসের সেরূপ স্থান। ভক্তি, সমাজবোধ এবং রসবোধের সংমিশ্রণে কৃত্তিবাস রামকথা পরিবেশন করেছেন। কবি দশরথের লোকাচারের পরিবর্তে বাঙালীর লোকাচারকে প্রকাশ করেছেন। কৃত্তিবাসের রামায়ণের প্রাপ্ত পুঁথির সংখ্যা কম, কিছু জায়গা থেকে পুঁথি পাওয়া গিয়েছে। সেগুলি বেশির ভাগ অষ্টাদশ শতাব্দীর অনুলিখন, দু-একটি সপ্তদশ শতাব্দীর, ষোড়শ শতাব্দীর পুঁথি নেই।
বাঙালী যা চায় কৃত্তিবাসী রামায়ণে তা পায়। বাঙালী জাতির হৃদয়ে কৃত্তিবাসী রামায়ণ চিরকালীন হয়ে আছে। সামাজিক, রাজনৈতিকভাবে বহু বিপর্যয় আসলেও বাঙালীর মূল্যবোধে ঘাটতি হয়নি। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে কৃত্তিবাসী রামায়ণের জনপ্রিয়তা একই প্রকার থেকেছে। বাঙালী জীবনকে পারিবারিক আদর্শের দিকে দৃঢ়সংবদ্ধ করে রেখেছে। আধুনিক যুগে সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক আদর্শের রূপ পরিবর্তন হয়েছে। জীবনের মূল্যবোধ পাল্টেছে কিন্তু কৃত্তিবাসের রামায়ণ জনপ্রিয়তা হারায়নি।
অনেকেই তাঁর রামায়ণকে পাঁচালীর শ্রেণীভুক্ত করেছেন। কেউ কেউ মহাকাব্য বলে থাকেন। কবি বাল্মীকিকে আক্ষরিকভাবে অনুবাদ না করলেও মূল রামায়ণকে গ্রহণ করেছেন। উত্তরাকাণ্ডের অনেক বিষয় বালকাণ্ডে বর্ণনা করেছেন। কৃত্তিবাস নররূপী রামের নারায়ণী সত্তার পূজারী, বাল্মীকির ধীরোদাত্ত রাম কথাবার্তায় বাঙালী লোকজীবনের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছেন। দশরথ কর্তৃক সিন্ধুবধ, রামের নির্বাসন, ভরত মিলন, সীতাহারা রামের বিলাপ, লক্ষ্মণের শক্তিশেল, সীতার অগ্নিপরীক্ষা ও নির্বাসন, সীতার পাতাল প্রবেশ কাহিনী সাধারণ মানুষের সুঃখ-দুঃখ-আনন্দের গীতিকাহিনী হয়ে উঠেছে। রামচন্দ্র প্রেমিক দেবতা, ভক্তবৎসল, রাবণ দুর্বিনীত হলেও সে প্রচ্ছন্ন ভক্ত। কৃত্তিবাসের নরনারীর চরিত্রে বাল্মীকির আর্যসুলভতা ও বাঙালীর জীবনাদর্শের সংযুক্তি ঘটেছে। তাঁর কাব্যে বীররস ও ভক্তিরস, বীর্য ও কারুণ্য বাংলাদেশের নরনারীর জীবনের ছায়ায় যেন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বাল্মীকিকে হুবহু অনুবাদ না করে তাঁর গল্পরসকে প্রাধান্য দিয়েছেন। বাঙালীর ভালোলাগা মন্দলাগা বিচার করে কার্তিকের জন্ম, বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্র বাদ দিয়েছেন। কিছু নতুন বিষয় যোগ করেছেন। অদ্ভুত রামায়ণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, জৈমিনি ভারত থেকেও কিছু বিষয়কে নিয়ে কবিকল্পনাকে বাণীরূপ দিয়েছেন।
লঙ্কাকাণ্ডে লক্ষ্মণ মূর্ছিত হলে হনুমানের ওষুধ আনা অদ্ভুত রামায়ণ থেকে নেওয়া। উত্তরাকাণ্ডে লব-কুশের দ্বারা ভরত, শত্রুঘ্ন, লক্ষ্মণ পরাজিত ও নিহত হলে বাল্মীকির ইচ্ছায় আবার প্রাণ ফিরে পায়- এ কাহিনী জৈমিনি ভারত থেকে নেওয়া। আদিকান্ডে দস্যু রত্নাকরের ‘মরা মরা’ বলে পাপমুক্ত হওয়া কৃত্তিবাসের নিজস্ব ভাবনায়- এটি অধ্যাত্ম রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ড থেকে নিয়েছেন। ভগীরথের জন্মবৃত্তান্ত যোগবশিষ্ট রামায়ণ থেকে নিয়েছেন। কৃত্তিবাসের মৌলিকতা ভক্তিবাদে। বাঙালী জীবনের প্রেক্ষপটে শ্রীরাম পাঁচালি লেখা। কাব্যের মধ্যের ভাবরস বাঙালীর অন্তরের জিনিস। বলা হয় যে তাঁর রামায়ণে বৈষ্ণবীয় দাস্যভক্তি ও শাক্তভক্তির ছায়া দেখা গেছে। কৃত্তিবাসী রামায়ণে রাম নামের মাহাত্ম্য ধরা পড়েছে। কৃত্তিবাসী রামায়ণে ভক্তির বিস্তার এবং ভক্ত ভগবানের আন্তরিক নিষ্ঠা রয়েছে। বাঙালী আবেগপ্রবণ, তাই খুব সহজেই ভক্তির বাংলা স্পষ্ট হয়েছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ কৃত্তিবাসী রামায়ণ নিয়ে বলেছেন, ‘কৃত্তিবাসের বাম ভক্তবৎসল রাম। যিনি অধার্মিক, পাপী সকলকেই উদ্ধার করেন।
কৃত্তিবাসী রামায়ণে পারিবারিক জীবনের শ্রেষ্ঠ আদর্শগুলি দেখা যায়। পিতৃভক্তি, প্রাতৃপ্রেম, পতিনিষ্ঠা, বাঙালীর নৈতিক আদর্শকে কবি কাব্যরূপ দিয়েছেন। সংস্কৃত রামায়ণের কাহিনীকে অবিকৃত রেখে বাঙালীর জীবনধর্মকে পরিস্ফুট করেছেন।