ঋকবৈদিক যুগে আর্যদের সমাজজীবন আলোচনা করো 2024 | ঋক বৈদিক যুগের ধর্মীয় জীবন সংক্ষেপে আলোচনা করো
সূচনা: – বৈদিক সভ্যতা ভারতীয় আর্যদের সৃষ্টি। আর্য বলতে কোনো জাতিকে বোঝায় না। আর্থ হল এক প্রাচীন ভাষাগোষ্ঠী। গ্রিক, হিরু, ল্যাটিন, সংস্কৃত, ইরানীয় এই পাঁচটি ভাষাকেই অর্থ বলা হয়। সংস্কৃত ভাষাভাষী আর্যরা আনুমানিক দেড় হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারতে বৈদিক সভ্যতার সূত্রপাত করেন। বৈদিক সভ্যতা বা বৈদিক যুগ দুটি ভাগে বিভক্ত। যথা-(ক) আদি বৈদিক বা ঋক বৈদিক যুগ ও (খ) পরবর্তী বৈদিক যুগ।
Contents
■ ঋকবৈদিক যুগের সমাজজীবন:
ঋকবেদ ও তার সমসাময়িক অন্যান্য সূত্র থেকে ঋকবৈদিক যুগের সমাজজীবনের বহু তথ্য পাওয়া যায়।
◆(১) পরিবার:
ঋক বৈদিক যুগে সামাজিক জীবনের মূল ভিত্তি ছিল পরিবার।
পরিবারগুলি ছিল পিতৃতান্ত্রিক। পরিবারকে বলা হত কুল। পরিবারের সর্বাপেক্ষা বয়স্ক পুরুষ ছিলেন পরিবারের সর্বময়কর্তা। তাকে গৃহপতি বা কুলপ বলা হত। পরিবারের সকলে তার নির্দেশ অবনত মস্তকে পালন করত। যৌথ পরিবার ছিল আর্য সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পিতা, মাতা সহ, পিতামহী এবং অন্যান্য পরিজন নিয়ে পরিবার গঠিত হত। পরিবারের প্রত্যেকের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।
◆(২) গৃহ:
ঋক বৈদিক যুগের সভ্যতা ছিল গ্রামীণ সভ্যতা। প্রতি পরিবারের স্থায়ী গৃহ থাকত। সাধারণত গৃহগুলি বাঁশ, খড় ও শনের ছাউনি দ্বারা তৈরি করা হত। পরবর্তীকালে মাটির দেওয়াল দ্বারা গৃহ নির্মাণের প্রথা চালু হয়। প্রতি গৃহে একটি করে অগ্নিকুণ্ড থাকত। এই অগ্নিকুণ্ড পোড়া মাটির ইটের দ্বারা তৈরি করা হত।
◆(৩) বিবাহ:
সাধারণত পিতামাতা বিবাহের পাত্রপাত্রী নির্বাচন করে দিতেন। অনেকক্ষেত্রে পাত্রপাত্রীর পরস্পরের পছন্দকে বিবাহের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া হত। সমাজে বাল্যবিবাহ বা বহুবিবাহ ছিল না। তবে অনেক ক্ষেত্রে পুরুষের একাধিক বিবাহের উদাহরণও পাওয়া যায়। বিধবাবিবাহের প্রচলন ছিল। সমাজে পণপ্রথা চালু ছিল।
◆(৪) বর্ণপ্রথা:
আর্যরা প্রথম যখন ভারতবর্ষে আসে তখন তারা নিজেদের দেহের আকৃতি, গায়ের রং প্রভৃতি সম্পর্কে খুবই সচেতন ছিল। আর্যরা ছিল গৌরবর্ণ। আর ভারতের অধিবাসীরা ছিল কৃষ্ণবর্ণ। বৈদিক যুগের প্রথম দিকে সমাজ দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। যথা- (ক) গৌরবর্ণ বিজেতা আর্য ও (খ) কৃষ্ণবর্ণ বিজিত দাস। কিন্তু জনসংখ্যা ও সামাজিক জটিলতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গুণ, কর্ম ও বৃত্তি অনুসারে সমাজে চারটি বর্ণের উদ্ভব হয়। যথা-ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। যারা শাস্ত্রপাঠ ও যাজযজ্ঞ করত তারা হল ব্রাহ্মণ। যারা যুদ্ধ ও রাজ্য শাসন করত তারা হল ক্ষত্রিয়। যারা ব্যবসা বাণিজ্য করত তারা হল বৈশ্য আর অনার্য দাসগণ শূদ্র নামে পরিচিত ছিল। উক্ত তিন শ্রেণির মানুষেরা পরস্পর বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হতে পারত। তারা যে কোনো বৃত্তি বা জীবিকা গ্রহণ করতে পারত।
◆(৫) চতুরাশ্রম প্রথা:
বৈদিক যুগে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই তিন বর্ণের প্রতিটি ব্যক্তির জীবন চারটি স্তরে বা আশ্রমে বিভক্ত ছিল। এই চারটি স্তর বা আশ্রম হল, যথা- (ক) ব্রহ্মচর্য (খ) গার্হস্থ্য (গ) বাণপ্রস্থ (ঘ) সন্ন্যাস।
(ক) ব্রহ্মচর্য:
ব্রহ্মচর্য ছিল অধ্যয়নের সময়। এই সময় আর্য বালক গুরুগৃহে বাস করে ব্রহ্মচর্য পালন ও বিদ্যাচর্চা করত।
(খ) গার্হস্থ্য:
গার্হস্থ ছিল যৌবনে গৃহী হয়ে সংসার ধর্ম পালন করা।
(গ) বানপ্রস্থ:
বানপ্রস্থ ছিল প্রৌঢ় বয়সে সংসার ত্যাগ করে অরণ্যবাসী হয়ে ধর্মানুষ্ঠানে ও ঈশ্বরচিন্তায় কালযাপন।
(ঘ) সন্ন্যাস:
শেষ জীবনে সন্ন্যাস অবলম্বন করে পরমাত্মার চিন্তায় নিজেদের ডুবিয়ে রাখা।
◆(৬) নারীর অবস্থান:
সমাজে নারীর স্থান ছিল সম্মানজনক। অন্তঃপুরের যাবতীয় কাজ তাদের যেমন করতে হত, তেমনি অন্তঃপুরের বাইরেও তারা পুরুষদের সহায়তা করতেন। স্ত্রীশিক্ষার প্রচলন ছিল। মেয়েদের মধ্যে কেউ কেউ বেদমন্ত্র রচনা, ধর্ম ও শাস্ত্রচর্চায় অংশগ্রহণ করত। লোপামুদ্রা, গার্গী, মৈত্রেয়ী প্রমুখ নারী তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
◆(৭) খাদ্য:
আর্যদের খাদ্যাভাস ছিল সাধারণ ও অনাড়ম্বর। আর্যদের খাদ্য ছিল দুধ, ঘি, ফলমূল, যব, গম ও নানা প্রকার পশুপক্ষীর মাংস। পিঠা ছিল আর্যদের প্রিয় খাদ্য। সুরা ও সোমরস ছিল প্রিয় উত্তেজক পানীয়। তবে সুরাপান সমাজে নিন্দনীয় ছিল।
◆(৮) আমোদ প্রমোদ
নাচ, গান, রথের দৌড়, পাশাখেলা, মুষ্টিযুদ্ধ, ধনুর্বাণ প্রতিযোগিতা প্রভৃতি ছিল আর্যদের আমোদ প্রমোদের প্রধান উপকরণ।
◆(৯) সংগীত চর্চা:
বৈদিক যুগে সংগীত বিদ্যা ও চারুকলার খুবই উন্নতি হয়েছিল। বাঁশি, বীণা, ঢোল, ঢাক প্রভৃতি সংগীতের সময় ব্যবহার করা হত। সামবেদকে গানের আকারে গাওয়ার রীতি ছিল।
◆(১০) পোষাক পরিচ্ছদ ও অলংকার
পশুর চামড়া দিয়ে আর্যরা পোষাক তৈরি করত। পোশকের তিনটি অংশ ছিল। যথা-অন্তর্বাস, নিম্নাঙ্গের পোশাক, উর্ধ্বাঙ্গের পোশাক। নারী ও পুরুষ উভয়ে অলংকার পরত। সোনা, রূপা ও দামী পাথরের অলংকার ব্যবহার করা হত।
• মূল্যায়ন:
বৈদিক যুগে আর্যদের সহজ সরল সামাজিক জীবন পরবর্তী সময়ে ক্রমশ জটিল হতে শুরু করে। ফলে সামাজিক ক্ষেত্রে নানা অবক্ষয়ের চিত্র ফুটে উঠতে দেখা যায়।