অনুবাদক হিসেবে কবি কৃত্তিবাসের কৃতিত্ব আলোচনা করো।
উত্তর: কবি কৃত্তিবাস সংস্কৃতে পণ্ডিত এবং নানা পুরাণ সম্পর্কে অভিজ্ঞ ছিলেন। তিনি বাল্মিকী রামায়ণের মূল কাহিনীর সারবস্তু নিয়ে পুরাণ ও অন্যান্য রামায়ণ থেকে কিছু বিষয় নিয়ে আপন মনের কল্পনা মাধুরী মিশিয়ে আর্য রামায়ণকে বাঙালি মানসের মতো করে এক রামায়ণ রচনা করেছিলেন। অনেকেই রামায়ণ রচনা করলেও কৃত্তিবাসের রামায়ণের পুঁথি বেশি পাওয়া গিয়েছে। রামায়ণের কৃত্তিবাস তাঁর নানা অনুভূতিকে পয়ার ত্রিপদী ছন্দে গ্রথিত করেছেন। তাঁর রামায়ণকে মূল রামায়ণের আক্ষরিক অনুবাদ না বলে বরং ভাবানুবাদ বলা চলে।তবে তিনি রামায়ণ রচনার সময় বাল্মিকী রামায়ণ ছাড়াও বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী রাম-সীতা, গ্রহণ করেছিলেন। কবি কৃত্তিবাসের রামায়ণ পাঁচালী বাঙালির গার্হস্থ্য জীবনকে মহত্তররূপে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। । শুধু রূপপিপাসা নয়, বাঙালির জীবনসাধনাকে লক্ষণ, দশরথের মাধ্যমে উচ্চতর সুস্থ জীবনাদর্শের দিকে পরিচালিত করেছেন। বাঙালির জীবনগীতা কৃত্তিবাসী রামায়ণ। সমস্ত চরিত্র এখানে বাঙালী হয়ে উঠেছে। ১৮০২-০৩ খ্রিস্টাব্দে রামায়ণ প্রথম ছাপা হয়, তবে কৃত্তিবাসের আবির্ভাবকাল ও তাঁর জীবনকথা সম্বন্ধে কিছু জানা যায়নি।
বাল্মিকী রামায়ণের রাম মহাকাব্যের বীর নায়ক। ভারতে দুটি ভক্তিধারা প্রচলিত ছিল- একটি কৃষ্ণভক্তি আর একটি রামভক্তি। রামায়ণে রামচন্দ্র ধীরে ধীরে অযোধ্যার ভূমি ছাড়িয়ে দেবলোকে উন্নীত হয়। রামায়ণের প্রভাবে অদ্ভুত রামায়ণ, যোগবিশিষ্ট রামায়ণ ও অধ্যাত্ম রামায়ণ রচিত হয়। বহু বছর ধরে কৃত্তিবাসের রামায়ণ বাঙালি জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে আসছে। এই মহাগ্রন্থ ‘শ্রীরাম পাঁচালী’ একদিকে অনন্ত অপার আনন্দ, অন্যদিকে লোকশিক্ষার বড়ো আধার। অনেকে কৃত্তিবাসী রামায়ণকে পাঁচালীর অন্তর্ভুক্ত করেছে। কৃত্তিবাসের রাম প্রেমিক দেবতা, ভক্তবৎসল, আবেগপ্রবণ; লক্ষ্মণ অপরিণামদর্শী, উদ্ধত; দশরথ ক্লীব স্ত্রৈন বৃদ্ধ, কৈকেয়ী, মন্থরা স্বার্থপর; ভরত ত্যাগ ও মহিমার আদর্শ। অন্যান্য চরিত্র ভক্তি-বীর করুণ রসে বাংলাদেশের মাটি আর্দ্র করে তুলেছে। সুখ-দুঃখ, বেদনা-আনন্দে কৃত্তিবাসী রামায়ণ মানব-জীবনরসে পূর্ণ।